স্পর্শ: প্রয়াত প্রব্রাজিকা ভক্তিপ্রাণাকে প্রণাম এক খুদে ভক্তের। সোমবার দক্ষিণেশ্বরে সারদা মঠের প্রধান কার্যালয়ে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
কাশীপুর শ্মশানে সোমবারের সন্ধ্যায় পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেল সারদা মঠ ও রামকৃষ্ণ সারদা মিশনের চতুর্থ অধ্যক্ষা প্রব্রাজিকা ভক্তিপ্রাণার নশ্বর দেহ। গত অক্টোবরে ১০২ বছর অতিক্রম করেছেন ভক্তিপ্রাণা মাতাজি। রবিবার রাতে রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে তাঁর জীবনাবসান হয়।
ভক্তিপ্রাণা মাতাজির প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অনেকেই। টুইটে মোদী বলেছেন, ‘সারদা মঠ ও রামকৃষ্ণ সারদা মিশনের মাধ্যমে সমাজসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাওয়ার জন্য প্রব্রাজিকা ভক্তিপ্রাণা মাতাজি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’ মমতা লিখেছেন, ‘প্রব্রাজিকা ভক্তিপ্রাণার জীবনাবসান সমস্ত অনুরাগী ও ভক্তদের কাছে অতুলনীয় ক্ষতি।’
রাজ্যের তরফে শ্রদ্ধা জানাতে এ দিন পরপর দুই মন্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রবিবার রাতে প্রয়াণের পরে হাসপাতাল থেকে ভক্তিপ্রাণা মাতাজির পার্থিব দেহ এনে রাখা হয়েছিল টালিগঞ্জের মাতৃভবন হাসপাতালে। এই মাতৃভবন ছিল তাঁর কর্মময় জীবনের অন্যতম একটি ঠিকানা। ভক্তিপ্রাণা মাতাজির নেতৃত্বেই টালিগঞ্জের ওই হাসপাতাল ১০ শয্যার প্রসূতি সদন থেকে ১০০ শয্যার আধুনিক হাসপাতাল হয়েছিল। সোমবার সেখানে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে যান প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য।
এ দিন সকাল ১০টা পর্যন্ত মাতৃভবনে অগণিত ভক্ত তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। সকাল সাড়ে ১০টার কিছু পরে টালিগঞ্জ থেকে প্রব্রাজিকা ভক্তিপ্রাণার পার্থিব দেহ নিয়ে আসা হয় দক্ষিণেশ্বরে সারদা মঠের প্রধান কার্যালয়ে। সেখানে অধ্যক্ষা মাতাজির বাসগৃহের দোতলায় দর্শনস্থলে শায়িত রাখা হয় প্রব্রাজিকা ভক্তিপ্রাণাকে। তাঁকে ঘিরে সন্ন্যাসিনীরা বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ করেন। সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। উপস্থিত ছিলেন বালির বিধায়ক রানা চট্টোপাধ্যায়। রামকৃষ্ণ মিশনের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে এসে ভক্তিপ্রাণা মাতাজিকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। শ্রদ্ধা জ্ঞাপন পর্ব শেষের পরে, চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী ভক্তিপ্রাণা মাতাজিকে স্নান করিয়ে, নতুন বস্ত্র পরিয়ে, জপের মালা দিয়ে দুপুর পৌনে তিনটে নাগাদ নিয়ে আসা হয় মা সারদার মন্দিরের সামনের চাতালে। সেখানে তাঁর আরতি করা হয়। এর পরে নিয়ে যাওয়া হয় কাশীপুর শ্মশানে। ৫টা ২০ নাগাদ শুরু হয় শেষকৃত্য। শেষ হয় ৬টা ২০ নাগাদ।
এ দিন সকাল থেকেই সারদা মঠ জুড়ে ছিল শোকস্তব্ধ পরিবেশ। প্রবীণ ও নবীন সকল সন্ন্যাসিনী থেকে ভক্ত, শিষ্যদের অনেকেই ‘বড় মাতাজি’র স্মৃতি চারণায় মগ্ন ছিলেন। প্রবীণ সন্ন্যাসিনী প্রব্রাজিকা নির্ভীকপ্রাণা জানান, স্কুলের পাঠ শেষ করে নার্সিং প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে সেবা কাজে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন ভক্তিপ্রাণা মাতাজি। তখন রামকৃষ্ণ মিশনের তরফে তাঁকে মাতৃভবনের কাজে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৫০ থেকে ২০০৯ সাল, জীবনের ৫৯ বছর ওই হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রব্রাজিকা ভক্তিপ্রাণা। তার মধ্যে ১৯৬১ সাল থেকে ছিলেন ওই হাসপাতালের সম্পাদক। দক্ষিণ কলকাতার ওই অঞ্চলে প্রায় সকলের কাছে তিনি ‘বড় মা’ নামেই পরিচিত ছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের প্রত্যক্ষ শিষ্য তথা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের চতুর্থ অধ্যক্ষ স্বামী বিজ্ঞানানন্দের কাছে মন্ত্র দীক্ষা নিয়েছিলেন ভক্তিপ্রাণা মাতাজি। এর পরে ১৯৫৪ সালে তাঁকে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষা দেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সপ্তম অধ্যক্ষ স্বামী শঙ্করানন্দ। ১৯৫৯ সালে তাঁর কাছেই সন্ন্যাস দীক্ষা গ্রহণ করেন প্রব্রাজিকা ভক্তিপ্রাণা। প্রব্রাজিকা নির্ভীকপ্রাণা আরও জানান, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রত্যক্ষ শিষ্যের দীক্ষিত শিষ্যা হিসেবে প্রব্রাজিকা ভক্তিপ্রাণাই ছিলেন শেষ প্রজন্ম। এমনকি ১৯৫৯ সালে সারদা মঠ স্বতন্ত্র সঙ্ঘ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সময় যে আট জনকে সন্ন্যাস দীক্ষা দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ও শেষ মানুষটি হলেন প্রব্রাজিকা ভক্তিপ্রাণা। নির্ভীকপ্রাণা মাতাজি বলেন, ‘‘একটা যুগের বা অধ্যায়ের অবসান হল। ওঁর আধ্যাত্মিক ও দীর্ঘ কর্মময় জীবন সকলের কাছে আদর্শ।’’
এ দিন সকাল থেকেই মঠে ভিড় জমিয়েছিলেন কলকাতা ও বিভিন্ন জেলার অসংখ্য ভক্ত ও অনুরাগীরা। কারও হাতে ছিল রজনীগন্ধার মালা, কেউ নিয়ে এসেছিলেন পদ্ম। তাঁরা চোখের জলে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ভক্তিপ্রাণা মাতাজিকে। যেমন, দক্ষিণেশ্বরের বাসিন্দা সোনালী ঘোষাল ও উত্তর কলকাতার রামমন্দির এলাকার বাসিন্দা সোমা শীল সকালে চলে এসেছিলেন মঠে। তাঁদের কথায়, ‘‘মাতাজির তুলনা নেই। উনি খুব সহজ সরল ছিলেন। সহজেই প্রত্যেককে আপন করে নিতে পারতেন। এমন এক জন মানুষ ছিলেন, যাঁকে মন খুলে সব কথা বলা যায়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy