আক্রান্ত শিক্ষক। —নিজস্ব চিত্র।
শিক্ষক নন, সে কলেজ ‘শাসন’ করে ছাত্রেরাই!
নদিয়ার মাজদিয়া এলাকায় সুধীররঞ্জন লাহিড়ি মহাবিদ্যালয় নিয়ে এটাই চালু রসিকতা।
কথাটা যে একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, শুক্রবার, কলেজের এক শিক্ষকের জামা ছিঁড়ে, তাঁকে ঘুষি মেরে তারই প্রমাণ রাখল এক দল ছাত্র।
অভিযুক্তেরা সকলেই টিএমসিপি সমর্থক বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষকেরা। তাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগও দায়ের করেছেন কলেজের অধ্যক্ষ।
পাঁচ বছর আগে, রাজ্যে পালাবদলের পরে, শাসক দলের ছাত্র সংগঠন টিএমসিপি-র দাপাদাপিতে তঠস্থ হয়েছিল শিক্ষাঙ্গন। কলকাতার যাদবপুর বিদ্যাপীঠে প্রধানশিক্ষককে মারধর দিয়ে যার সূত্রপাত।
তার পর, কখনও রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে অধ্যক্ষকে লাথি-ঘুষি মারার ঘটনা, দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর কলেজে ছাত্র তাণ্ডব কখনও বা রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি চালানোর ঘটনা— বার বারই আঙুল উঠতে থাকে টিএমসিপি-র দিকে। সেই তালিকায় ছিল মাজদিয়ার সুধীররঞ্জন লাহিড়ি মহাবিদ্যালয়ও। তবে, টিএমসিপি নয়, সেখানে শিক্ষক নিগ্রহে অভিযুক্ত ছিল এসএফআই।
কলেজের অধ্যক্ষ সরোজেন্দ্রনাথ কর’কে টেবিলের ভাঙা পায়া দিয়ে মারধরের অভিযোগ দায়ের হয়েছিল থানায়। গ্রেফতারও হয়েছিল পাঁচ এসএফআই সমর্থকও। সে ঘটনার পরেও ছাত্র তাণ্ডবের জেরে মাঝে মধ্যেই উঠে এসেছে ওই কলেজের নাম।
দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফিরে, মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন— স্কুল-কলেজে ছাত্রদের ‘বাড়াবাড়ি’ বরদাস্ত করবেন না তিনি। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যাও দিন কয়েক আগে জানিয়ে দিয়েছিলেন— শিক্ষাক্ষেত্রে দাপাদাপি কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। গন্ডগোল বাধলে ‘রাজনীতির রং’ না দেখেই পুলিশকে ব্যবস্থা নেওয়ারও ছাড়পত্র দেন তিনি।
এ দিন অবশ্য সে পথে হাঁটেনি কৃষ্ণগঞ্জ থানা। পুলিশ জানায়, কলেজ কর্তৃপক্ষের দায়ের করা কোনও অভিযোগই তাদের হাতে পৌঁছয়নি।
নদিয়া জেলা পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া বলেন, ‘‘স্থানীয় থানায় খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তারা কোনও অভিযোগই পায়নি। পেলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
কী হয়েছিল এ দিন?
কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, শুক্রবার, কলেজের তৃতীয় বর্ষের প্রতিরক্ষা বিদ্যার প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা ছিল। সে পরীক্ষায় ছাত্রেরা কে কত নম্বর পেল, তা যাতে বুঝতে না পারে তারা, সে জন্য ‘এ’-‘বি’ গ্রেড লিখে নম্বর দিচ্ছিলেন বিভাগীয় শিক্ষক। ছাত্রদের একাংশ আপত্তি তুলেছিল তাতেই।
পরীক্ষা পর্ব মিটে যাওয়ার পরে, টিএমসিপি-র এক দল সমর্থক প্রথমে অধ্যক্ষের কাছে এ নিয়ে দরবার করে। তিনি অবশ্য তাদের বিশেষ আমল দেননি। এ বার তারা ঢুকে পড়ে শিক্ষকদের কমন রুমে। দাবি একটাই— ও ভাবে নম্বর দেওয়া যাবে না। শিক্ষকদের ‘অপমানজনক’ কথাও বলতে থা তারা বলে অভিযোগ।
এক শিক্ষক বলেন, ‘‘বেশ কিছুক্ষণ ধরে ছেলের বয়সী ছাত্রদের মুখে গালমন্দ শুনে উত্তেজিত হয়ে তাদের মুখ বন্ধ করতে বলেন প্রতিরক্ষাবিদ্যা বিভাগের প্রধান সুব্রত রায়। আর তাতেই ঘটে বিপত্তি।’’
শিক্ষকেরা জানান, শুভজিৎ পাল নামে টিএমসিপি সমর্থক এক ছাত্র সব্রতবাবুর দিকে তেড়ে গিয়ে তাঁর কলার চেপে ধরে। শুরু হয়ে যায় ধাক্কাধাক্কি। সেই সময়েই কেউ সুব্রতবাবুর মুখে সজোরে ঘুসি মারে।
এখানেই থামেননি ছাত্রেরা। শিক্ষকদের অভিযোগ, বাইরে থেকে তালা দিয়ে কমন রুমেই তাঁদের আটকে রাখা হয় দীর্ঘক্ষণ।
খবর পেয়ে কলেজে আসেন তৃণমূলের কৃষ্ণগঞ্জ ব্লক সভাপতি লক্ষ্মণ ঘোষ চৌধুরী। তিনিই তালা খুলে শিক্ষকদের মুক্ত করেন। বেশ কিছুক্ষণ তাঁদের সঙ্গে বৈঠকও করেন তিনি। এক শিক্ষকের কথায়, ‘‘আলোচনার সময়ে ওই তৃণমূল নেতা বার বারই ব্যাপারটা মিটিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন আমাদের। আমরা অবশ্য রাজি হইনি।’’
ওই তৃণমূল নেতা অবশ্য সে কথা মানছেন না। তাঁর সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘আমি অন্য কাজে কলেজে গিয়েছিলাম। কাজ মিটে গেলেই চলে যাই। কারও সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি।’’
তবে টিএমসিপি-র তাণ্ডবের কথা মেনে নিয়েছেন সরজেন্দ্রবাবু। তিনি বলেন, ‘‘পরীক্ষার নম্বর সংক্রান্ত বিষয়ে নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে সুব্রতবাবুর বচসা হয়। তার জেরেই শুভজিৎ পাল নামে এক ছাত্র ওই শিক্ষকের উপরে চড়াও হয়ে তাঁকে নিগ্রহ করেছে বলে শুনেছি।’’ শিক্ষকদের অভিযোগ যে তিনি থানায় পাঠিয়েছেন, মেনে নিয়েছেন তা-ও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy