আলোচনাসভায় নমন পি আহুজা। শুক্রবার। ছবি: প্রদীপ আদক।
এক দেবতা দাঁড়িয়ে আছেন রথে। ভেড়ায় টানা সেই রথ চলেছে নগরীর মাঝখান দিয়ে। উত্তর ২৪ পরগনার বেড়াচাঁপার কাছে চন্দ্রকেতুগড়ে পোড়ামাটির ফলকে খোদাই করা এমন দৃশ্য দেখে পুরাতত্ত্ববিদেরা ধরে নিয়েছিলেন, ওই দেবতা অগ্নি। ভেড়া যে তাঁরই বাহন। সেই থেকে এটাও ধরে নেওয়া যাচ্ছিল, চন্দ্রকেতুগড়ে যে প্রাচীন সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল, তার অনুপ্রেরণা ছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্ম।
শুক্রবার, ভারতীয় সংগ্রহশালার আশুতোষ জন্মশতবার্ষিকী হলে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় শিল্পতত্ত্বের অধ্যাপক নমন পি আহুজা বললেন, ‘‘আমিও মনে করতাম তেমনটাই। কিন্তু পরে মনে হল, গান্ধার ভাস্কর্যে দেখা যায়, কপিলবাস্তুতে সিদ্ধার্থ যখন বিদ্যালয়ে যাচ্ছেন, সেই রাজপুত্রের রথও টানছে ভেড়ায়। সেখানেও চারদিকে ভিড় করে আছেন নগরীর লোক।’’ দু’টি ছবি পরপর দেখিয়ে নমনের প্রশ্ন, ‘‘কেন তা হলে বুদ্ধের জীবনের কাহিনির সঙ্গে এই দৃশ্যকে মেলাব না?’’ তাঁর কথায়, ‘‘গান্ধার ও মথুরার শিল্পরীতিতে সিদ্ধার্থের জীবনের এই কাহিনির শিল্পরূপ দেখতে পাওয়া যায়। তারই প্রভাব পূর্ব ভারতের উপকূল এলাকার সভ্যতায় পড়েনি, এমনটা জোর দিয়ে কেন বলা হবে? যে গ্রন্থ থেকে গৌতমের জীবনের এই কাহিনি পাওয়া যায়, সেই ললিতবিস্তর খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের চেয়ে পুরনো নয়। তাই এই কাহিনি তখন ভালই প্রচলিত ছিল।’’
গান্ধারের সঙ্গে চন্দ্রকেতুগড়ের দৃশ্যের অমিল হল চরিত্রগুলির পোশাকে। তাতে দু’টি দৃশ্যায়ন দুই পৃথক ধর্মবিশ্বাস-প্রভাবিত বলে অবশ্যই মনে হতে পারে। মার্গ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক নমনের প্রশ্ন, ‘‘মিল কাহিনিতে। অমিল পোশাকে। কিন্তু এমন কথা কেন আমরা মেনে নেব যে, আফগানিস্তানে যে পোশাক বিগ্রহকে পরানো হতো, সম্পূর্ণ ভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চল, সুদূর বাংলার উপকূলে তেমনই পোশাক পরানো হবে?’’
এখানেই নমনের পরের যুক্তি— চন্দ্রকেতুগড়ের সমাজ তার স্থানীয় বিশ্বাসের উপরেই ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। তার নিজস্ব শিল্পভাবনা ছিল। ‘চন্দ্রকেতুগড়ের পোড়ামাটির শিল্প নিদর্শন কি বৌদ্ধধর্মেরই অন্য ধারার প্রকাশ’ শীর্ষক এ দিনের আলোচনায় নমন বলেন, চন্দ্রকেতুগড়ের সমাজে তাই স্থান পেয়েছিল বৌদ্ধ বিশ্বাসও। তিনি আরও বলেন, চন্দ্রকেতুগড় থেকে পাওয়া গিয়েছে দেহাস্থি রাখার পবিত্র আধারও। ছিল স্তূপও। যা, নমনের কথায়, নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবে সম্ভবত সেই স্তূপেরই গায়ে থাকা পোড়ামাটির ফলকগুলির কিছু কিছু পাওয়া গিয়েছে। এই সবই অবশ্য রয়েছে নানা ব্যক্তির নিজস্ব সংগ্রহে।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত যে সময়কালে চন্দ্রকেতুগড়ের সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশ, সেই সময় সারা ভারতেই বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব বাড়ছে। চন্দ্রকেতুগড়ের সঙ্গে তুলনীয় পোড়ামাটির ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছে দক্ষিণ বাদে প্রায় সারা ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়েই। গৌতমের জীবনের নানা ঘটনা ধরে কাহিনি নির্মাণ করা হচ্ছে ভারহুত থেকে সাঁচী, নানা জায়গায়। চন্দ্রকেতুগড় থেকে পাওয়া, পোড়ামাটিতে গড়া যেমন একটি দৃশ্যের সঙ্গে বুদ্ধের শ্রাবস্তীর প্রাতিহার্যের কাহিনির মিল রয়েছে। যেখানে বুদ্ধের কাঁধ থেকে আগুন আর পায়ের পাতা দিয়ে জল বেরোতে দেখা যায়। নমন বলেন, ‘‘ভারতের অন্যত্র বোধিসত্ত্বের হাতে অভয় মুদ্রা দেখতে পাই। এখানে তাঁর বজ্রমুষ্টি। এটিই চন্দ্রকেতুগড়ের নিজস্ব ভাবনা।’’ আলোচনাসভার সভাপতি ছিলেন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের প্রাক্তন মহানির্দেশক গৌতম সেনগুপ্ত। তাঁর কথায়, ‘‘ভারতীয় পুরাতত্ত্বের একটি অত্যন্ত জটিল সমস্যাকে নমন নতুন ভাবে বিচার করতে চেয়েছেন। তিনি নতুন ভাবনা শোনালেন, নতুন প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেলেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy