সুখ: ধর্মতলার এক বিপণিতে। বুধবার। ছবি: সুদীপ ঘোষ
গোলগাল, মেদুর ‘রসগুল্লা’-সুলভ ভাবমূর্তি নিয়ে অস্বস্তিই বরং এত দিন চোখে পড়েছে। রসগোল্লা নিয়ে বাঙালির আত্মশ্লাঘা আগে এতটা বোঝা যায়নি।
‘জি আই’ বা ‘জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন’ তকমাটা বোঝেন ক’জন, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। বুধবার, ‘বাংলার রসগোল্লা’র খেতাব জয়ের ‘ভরসা পূর্তি’র দিনটা তবু রসে-বশেই কাটাল বাঙালি।
নিন্দুকেরা বলছেন, এই উদ্যাপন আদতে পড়শি রাজ্যকে এক ধরনের খোঁচা মারার উল্লাস! তাদের রসগোল্লার উৎকর্ষ বা পরম্পরার বিষয়ে ওড়িশা শেষমেশ চেন্নাইয়ে ‘জি আই’ রেজিস্টারের দফতরে দাবিই পেশ করে উঠতে পারেনি। কিন্তু রসগোল্লার আঁতুড়ঘর নিয়ে উৎকলীয়দের সঙ্গে বিতর্কের সূত্রপাত মাত্র কোমর বেঁধে নেমে স্বীকৃতি ছিনিয়ে নেয় বাংলা। শোনা গিয়েছিল, ‘জি আই’-এর লোগো ব্যবহার করে রসগোল্লার ব্র্যান্ডিংয়ের সুবাদে ভিন্ রাজ্যে বা বিদেশে বিপণনে তরতরিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলার মিষ্টি। বাস্তবে মিষ্টি-স্রষ্টাদের নয়া লোগো ব্যবহার শুরুই হয়নি। তবু বচ্ছরকার দিনটি উদ্যাপনের আয়োজনে কিছুই কম পড়ছে না।
‘রসগোল্লার কলম্বাস’ নবীন দাশের নাতির নাতি ধীমান দাশ এই স্বীকৃতি তাঁদের পারিবারিক মিষ্টি-ব্র্যান্ডের সাফল্যগাথা হিসেবেই দেখছেন। ধর্মতলায় কেসি দাশের বিপণীতে ধীমানদের আপ্যায়নে আমন্ত্রিত এক ঝাঁক পরিবারহীন দুঃস্থ নাবালক। শিশু ও নারীকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা তাদের রসগোল্লা খাইয়ে দিলেন। নিউ টাউনের মিষ্টি-হাবে নানা কিসিমের রসগোল্লা-চর্চা দেখে অভিভূত হিডকো-র চেয়ারম্যান দেবাশিস সেন। বলছেন, ‘‘স্ট্রবেরি, কমলার ফ্লেভার থেকে লঙ্কার রসগোল্লা! রসের এত প্যাঁচ, কে জানত!’’ তবে এই লঘু চালের আনন্দের বাইরে দিনটার গভীরতর তাৎপর্যই উঠে এল না। দেবাশিসবাবুর কথায়, ‘‘এই স্বীকৃতি লাভ উপলক্ষে কিছু একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে, এটা সবারই ভাল লাগছে।’’
তবে বাংলার রসগোল্লা স্বীকৃতি পেলেও রসগোল্লাকে নিখাদ বাঙালি বলে দেখা নিয়ে ইতিহাসবিদদের অনেকেরই আপত্তি আছে। আঠারো শতকে পর্তুগিজ পাদ্রিদের সংস্পর্শে ‘পট চিজ়’ তৈরির কসরত থেকে সন্দেশ-রসগোল্লার উপযোগী ছানা সৃষ্টির বিদ্যে আয়ত্ত করে গঙ্গাপাড়ের ময়রাকুল। এবং উনিশ শতকে ইংরেজদের সৌজন্যে ছড়িয়ে পড়া পরিশুদ্ধ সাদা চিনির কল এ দেশের সামাজিক জীবনটাই পাল্টে দেয়। গুড় থেকে তৈরি আগেকার হলদে চিনিতে কস্মিনকালেও রসগোল্লা সৃষ্টি সম্ভব হত না বলে মনে করেন বাংলার তাবড় মিষ্টি-স্রষ্টারা। ছানা ও চিনি— এই দুই বিজাতীয় আহরণের যুগলবন্দিতেই ধাপে ধাপে রসগোল্লা সৃষ্টির পথে এগিয়ে যায় বাঙালি।
বাঙালি মিষ্টির অন্যতম ইতিহাসবিদ হরিপদ ভৌমিক মনে করাচ্ছেন, ভবিষ্যতে স্পঞ্জ রসগোল্লার আবিষ্কর্তা নবীন দাশের পরিবারও কাশী মিত্র ঘাটের পাশে চিনির কলের ব্যবসায় জড়িয়ে ছিল। চিনির চরিত্র সম্বন্ধে নবীনের বাড়তি জ্ঞান থাকা তাই বিচিত্র নয়। সেই রসগোল্লার প্রসারেও জড়িয়ে রয়েছেন জনৈক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী। ভগবানদাস বাগলার পুত্র চিৎপুরে দাশেদের খাপরার দোকানে জল খেতে ঢুকে এই আশ্চর্য রসের গোলকের স্বাদ পেয়েছিলেন।
বাগলারা রসগোল্লার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন। দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণের যুগেই বাঙালির সাংস্কৃতিক চিহ্ন হয়ে ওঠে রসগোল্লা।
খাদ্য ইতিহাসবিদ উৎসা রায় বাঙালির এই রসগোল্লা-গরিমায় অন্যায় কিছু দেখছেন না। ‘‘যে কোনও সাংস্কৃতিক গৌরবই আসলে পাঁচমিশেলি প্রভাবের ফসল’’— মনে করাচ্ছেন উৎসা। ঘটনাচক্রে, রসগোল্লার ‘জি আই’ লোগো-র নেপথ্যেও এক তামিলভাষী আমলা। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি দফতরের তৎকালীন সচিব, অধুনা অবসরপ্রাপ্ত রিনা বেঙ্কটরামন। কলকাতায় চাকরিসূত্রে এসেই রসগোল্লার মর্ম বুঝেছিলেন তিনি।
লোগোয় গোলাকার রসগোল্লার মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র। নীচে রোমান হরফে লেখা, ‘বাংলার রসগোল্লা’! উপরে দেবনাগরীতে, অখিলং মধুরাম! শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে এমএস সুব্বুলক্ষ্মীর গান থেকে শব্দটা ধার করেন রিনা। ‘‘টোটাল সুইট! আর কী বলা যায় রসগোল্লাকে।’’
এক গোল্লায় বাংলা, ভারত, বর্হিবিশ্ব একাকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy