অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র
আইপ্যাক সংক্রান্ত জটিলতা এবং তার ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতির জেরে কি তৃণমূলের সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়? পরিস্থিতি যেদিকে চলেছে, তাতে এমন সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। অভিষেকের ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি, আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি গোয়ায় বিধানসভা ভোটের পর অভিষেক ওই সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে পারেন। তবে পাশাপাশিই তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, গোয়ার ভোট সোমবার। এখনও দিনদুয়েক দেরি। তার মধ্যে পরিস্থিতি বদলালেও বদলাতে পারে। কারণ, ঘটনা প্রতিমুহূর্তে বাঁক নিচ্ছে।
বৃহস্পতিবার গোয়ায় দু’টি নির্বাচনী সভা করেছেন অভিষেক। সেখানে তিনি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই বিজেপি এবং কংগ্রেসকে আক্রমণ করেছেন। প্রচার সেরে শুক্রবার দুপুরে অভিষেকের গোয়া থেকে ফেরার কথা। কিন্তু গোয়ার ভোট হওয়ার আগে তিনি কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন না। কারণ, গোয়ায় ভোটের দায়িত্বে তিনিই। সোমবার গোয়ায় ভোট শেষের পর বা মঙ্গলবার তিনি প্রকাশ্যে তাঁর অবস্থান জানিয়ে দিতে পারেন। তবে তার মধ্যে তাঁর সঙ্গে তৃণমূলে সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখোমুখি আলোচনা হলে পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে দলের আশাবাদী অংশের দাবি।
দলের একাংশে আবার জল্পনা, অভিষেক ‘পাল্টা চাপ’ দিতে চাইছেন। এবং সেটা তিনি করতে চাইছেন পদ ছাড়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে। যদিও অভিষেকের ঘনিষ্ঠ এক নেতা শুক্রবার বলেছেন, ‘‘এর মধ্যে পাল্টা চাপের রাজনীতির কোনও প্রশ্নই নেই। অভিষেক মনে করছেন, তিনি যা করতে চাইছেন, তা করতে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতে পদ আঁকড়ে থেকে কি কোনও লাভ আছে! তার চেয়ে সাংসদ হিসেবে নিজের লোকসভা কেন্দ্রের মানুষের জন্য কাজ করাই ভাল।’’
অভিষেকের ঘনিষ্ঠরা অবশ্য স্পষ্টই বলছেন, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে তাঁর তীব্র অভিমান হয়েছে। অবস্থা সাপেক্ষে অভিষেক সম্ভবত ‘ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ’ হিসেবেই থাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন। গোয়া থেকে নিজের কিছু ঘনিষ্ঠকে অভিষেক এমনও জানিয়েছেন যে, তিনি রাজনীতি থেকে দূরেই থাকতে চান। সেক্ষেত্রে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরে যাওয়া ছাড়া তাঁর কাছে আর কোনও বিকল্প আপাতত নেই। তবে সেটা তিনি করবেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর ‘পূর্ণ আস্থা’ রেখেই। ঘনিষ্ঠরা অভিষেককে তাঁর সিদ্ধান্ত পুর্নর্বিবেচনা করতে বললেও এখনও পর্যন্ত তিনি অনড় বলেই খবর।
পরিস্থিতি যেদিকে চলেছে, তাতে বিরক্ত মমতাও। কারণ, বিষয়টি দাঁড়িয়ে গিয়েছে একদিকে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী এবং অন্যদিকে আইপ্যাক এবং অভিষেক। পুরভোটের প্রার্থিতালিকা নিয়ে যে টানাপড়েন তৈরি হয়েছিল, তাতে ক্ষুব্ধ হন পার্থ-বক্সী। অসমর্থিত সূত্রের খবর, তাঁরা দলনেত্রীকে এমনও বলেছিলেন যে, ক্যামাক স্ট্রিটে গিয়ে নির্দেশ নেওয়ার চেয়ে বরং দল করা ছেড়ে দেবেন!
তার পরেই ওই বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ’ করেন মমতা। অভিষেকের ঘনিষ্ঠ নেতাদের মতে, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি দলের অন্দরে একটা শৃঙ্খলা এবং কাঠামো আনার চেষ্টা করছেন। গত ২০১১ সালে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর মমতা সুচারু ভাবে সরকার চালিয়েছেন। এখনও চালাচ্ছেন। কিন্তু দলের আলাদা করে কোনও ‘পরিচিতি’ তৈরি হয়নি। ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দল যেভাবে চলেছে, তাতে সামগ্রিক ভাবে দলের ভাল হয়নি। মমতা নিজে ‘নক্ষত্র’। কিন্তু তাঁর পরের পর্যায়ের নেতাদের তৈরি করতে হবে।
অভিষেকের ‘মুড’ বুঝে তাঁর ঘনিষ্ঠেরা ইতিমধ্যেই নেটমাধ্যমে ‘এক ব্যক্তি, এক পদ’ নীতির সমর্থনে পর পর পোস্ট করতে শুরু করেছেন। অভিষেকের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত যুব তৃণমূলের এক সাধারণ সম্পাদক পুরভোট নিয়ে যে পোস্ট করেছেন, তা যথেষ্ট ‘অর্থবহ’। সেখানে তিনি লিখেছেন পুরভোটে পুলিশকে ‘১০০ শতাংশ ফ্রি হ্যান্ড’ দেওয়া উচিত।
এসবের ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে বলেই দলের একাংশের বক্তব্য। এই অংশ চাইছে, মমতা এবং অভিষেক— দু’জনের নেতৃত্বেই কাজ করতে। এমনকি, পার্থ-বক্সীও ‘ভুল বোঝাবুঝি’ মেটাতে চান বলেই খবর। তবে অভিষেক তাঁর ঘনিষ্ঠদের জানিয়েছেন, পার্থ-বক্সী দল চালালে তাতে তাঁর কোনও আপত্তি নেই। তিনি শুধু ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ হয়ে তাঁর লোকসভা কেন্দ্রের কাজ করবেন। অভিষেকের ঘনিষ্ঠরা জানাচ্ছেন, দলের পদে থেকে যদি তিনি কাজটাই করতে না-পারেন, তা হলে সে পদ রেখে লাভ কী, এমন মনোভাবও উঠে আসছে।
সব মিলিয়ে, পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোরালো হচ্ছে। ঘটনাপ্রবাহে মমতা যে বিরক্ত, তা তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠদের কাছে গোপন করেননি। পাশাপাশি, আইপ্যাকের সঙ্গেও দলের বর্ষীয়ান নেতাদের দূরত্ব বাড়ছে। দলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায় আইপ্যাক সম্পর্কে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছিলেন। তাঁকে তৃণমূলের লোকসভার নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় মৌখিক ভাবে ‘সতর্ক’ করেছেন। সৌগত তার পর থেকে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। কিন্তু আইপ্যাকের সঙ্গে তৃণমূলের যে প্রায় অনতিক্রম্য দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে দলের নেতাদের বড় অংশ নিঃসন্দেহ।
তবে দলের নেতাদের একটি অংশ মনে করছে, মমতা-অভিষেক একবার মুখোমুখি বসে কথা বললে পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যেতে পারে। কিন্তু শুক্রবার পর্যন্ত তেমন কোনও সম্ভাবনা দেখা যায়নি। বস্তুত, অভিষেকের ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, দলের সর্বময় নেত্রী কেন ‘বাইরের লোক’-দের কথা শুনছেন, তা নিয়েও অভিষেকের মনে অভিমান জমাট বেঁধেছে। অন্যদিকে, মমতাও অভিষেকের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য নিয়ে ক্ষুণ্ণ। নিজের ঘনিষ্ঠদের কাছে সে কথা তিনি গোপনও করেননি। ফলে উভয় তরফের মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়ছে। পুরভোটের আগে এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের অন্দরে উদ্বেগ এবং জল্পনা তৈরি হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy