Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
তৃণমূলে চিঠি-চাপাটি

নথি চাইলেন বক্সী, মুকুল বললেন নেই

চিঠিতে চাপানউতোর! সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তের সূত্রে তৃণমূল ভবনে সিবিআই আধিকারিকের ফোনের পরের দিনই সুব্রত বক্সী ও মুকুল রায়ের চিঠি-পাল্টা চিঠি ঘিরে সরগরম শাসক দলের অন্দর মহল। তৃণমূলের গত কয়েক বছরের আয়ব্যয়ের হিসেবপত্র, এমনকী মমতা বন্দ্যোপাধায়ের ছবি বিক্রি করে পাওয়া টাকার হিসেব চেয়ে গত মাসের গোড়ায় মকুল রায়কে চিঠি পাঠিয়েছিল সিবিআই। যার উত্তরে মুকুল জানিয়েছিলেন, তিনি আর দলের পদাধিকারী নন। ফলে ওই হিসেবপত্রও তাঁর কাছে নেই। সে সবই থাকার কথা দলের হেফাজতে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪৭
Share: Save:

চিঠিতে চাপানউতোর!

সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তের সূত্রে তৃণমূল ভবনে সিবিআই আধিকারিকের ফোনের পরের দিনই সুব্রত বক্সী ও মুকুল রায়ের চিঠি-পাল্টা চিঠি ঘিরে সরগরম শাসক দলের অন্দর মহল। তৃণমূলের গত কয়েক বছরের আয়ব্যয়ের হিসেবপত্র, এমনকী মমতা বন্দ্যোপাধায়ের ছবি বিক্রি করে পাওয়া টাকার হিসেব চেয়ে গত মাসের গোড়ায় মকুল রায়কে চিঠি পাঠিয়েছিল সিবিআই। যার উত্তরে মুকুল জানিয়েছিলেন, তিনি আর দলের পদাধিকারী নন। ফলে ওই হিসেবপত্রও তাঁর কাছে নেই। সে সবই থাকার কথা দলের হেফাজতে।

কিন্তু গত ১৮ মার্চ মুকুলকে লেখা তৃণমূলের নতুন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সীর যে চিঠি এ দিন প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে প্রকারান্তরে এই দাবিই করা হয়েছে যে, আয়ব্যয়ের ওই সব নথি দলের কাছে নেই। কারণ, ওই চিঠিতে সুব্রত যে সব নথি চেয়ে পাঠিয়েছেন, তার মধ্যে রয়েছে, ‘জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের আওতায় নির্বাচন কমিশনের কাছে পেশ করা যাবতীয় হিসেবের আসল নথি, অডিট করা বার্ষিক আয়ব্যয়ের আসল নথি, আয়কর রিটার্নের নকল’। সুব্রতর লেখা চিঠির বয়ান শুনে বিস্মিত তৃণমূল নেতাদের একাংশ। এক শীর্ষ নেতার কথায়, ‘‘এ কথা লেখার মানে তো এই যে, তৃণমূলের দফতরে এই সব গুরুত্বপূর্ণ নথির কোনওটাই নেই! এ রকম আবার হয় নাকি! দলের অফিসেই তো এ সব নথি রাখা হয়! কোথায় গেল এই সব ফাইল?’’

কী বলছেন মুকুল?

শুক্রবারই স্পিড পোস্টে তৃণমূল ভবনের ঠিকানায় চিঠির জবাব পাঠিয়েছেন দলের সদ্য প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। সেখানে মুকুলের দাবি, কোনও আসল নথিই তাঁর কাছে নেই। যা আছে সবই ফটো কপি। সেগুলি চিঠির সঙ্গেই পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। মুকুল এ দিন বলেন, ‘‘বক্সীর চিঠি আমি ২৩ মার্চ পেয়েছি। তার পর বাইরে থাকায় উত্তর দিতে পারিনি। কাল রাতে ফিরেছি। আজই জবাব পাঠিয়েছি।’’

মুকুল এবং সুব্রত, দু’জনের দাবিই যদি সত্যি হয়, তা হলে দলের আয়ব্যয় সংক্রান্ত কোনও আসল নথির হদিস নেই! তৃণমূলের ভিতরেই তাই প্রশ্ন উঠেছে, মূল নথি যদি দলীয় দফতর থেকেই লোপাট হয়, তা হলে কেন অবিলম্বে পুলিশকে বিষয়টি জানানো হচ্ছে না। বিশেষ করে যখন এই নথি ও তথ্য খতিয়ে দেখার জন্যই সিবিআই দলের শীর্ষনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে।

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

তৃণমূল নেতাদের একটি অংশের অবশ্য দাবি, সব নথি তৃণমূল ভবনেই রয়েছে। সুব্রত সদ্য দায়িত্ব নিয়েছেন, ফলে সবটা জানা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু ওই যুক্তি মানতে নারাজ দলের অন্য অংশ। তাঁদের বক্তব্য, মুকুলের চেয়ারে সদ্য বসলেও সুব্রত দীর্ঘদিন ধরেই দলের অন্যতম শীর্ষনেতা। দলের কার্যালয়ে কার কাছে কী নথি থাকে, এ সবই তাঁর জানা। আর তিনি নিশ্চয়ই তৃণমূল ভবনে খোঁজ না-করে মুকুলকে চিঠি লেখেননি।

সিবিআই যখন আয়ব্যয়ের হিসেব পেতে সক্রিয় হচ্ছে, বৃহস্পতিবার তৃণমূল ভবনে ফোন করে সুব্রত বক্সীর খোঁজ করার পরে শুক্রবার নিয়মমাফিক নোটিস পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন তৃণমূল সব দায় মুকুলের ঘাড়ে ঠেলে দিতে চাইছে কি না, সেই প্রশ্নও অবশ্য উঠছে। কারও কারও অভিযোগ— আয়ব্যয়ের আসল নথি দলের কাছে নেই এবং সবটাই মুকুলের কারসাজি, এমন একটা আভাস দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে সুব্রতর চিঠির মধ্যে। তাঁদের মতে, এই সব নথি ও আয়কর রিটার্নে ‘ত্রিনেত্র’-র মতো সন্দেহজনক সংস্থার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার মতো নানা গোঁজামিল রয়েছে। এখন এই সব নথি মুকুলবাবু হাতিয়ে নিয়েছেন বলতে পারলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়। এক, নথি হারিয়ে গিয়েছে বলে পুলিশের কাছে এফআইআর করা হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য কিছুটা সময় পাওয়া যাবে। কারণ, সে ক্ষেত্রে সিবিআই-কে সরকারি বিভিন্ন দফতর ঘুরে ওই সব নথি সংগ্রহ করতে হবে। দুই, নথি লোপাটের দায় মুকুলবাবুর ঘাড়ে চাপিয়ে তাঁকে বিড়ম্বনায় ফেলা যাবে।

তৃণমূলের তরফে অবশ্য এ দিন সরকারি ভাবে এই চিঠি-চাপাটি নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি। সুব্রত বক্সীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের যা বলার তা উপযুক্ত জায়গায় বলব।’’ নথি লোপাটের জন্য পুলিশের কাছে কোনও এফআইআর করা হবে কি না তা নিয়েও কোনও কথা বলতে চাননি তিনি। তবে দলের অন্দরে শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্য, তৃণমূলে এখন মুকুলের কোনও গুরুত্বই নেই। ফলে তিনি কী চিঠি লিখলেন, তারও কোনও দাম দলের কাছে নেই। পাশাপাশি, যাঁকে মুকুল চিঠি লিখলেন, তিনি চিঠি হাতে পাওয়ার আগেই, বস্তুত চিঠি ডাকে দিয়েই তা সংবাদমাধ্যমে ফাঁস করে দেওয়ার পিছনে দুরভিসন্ধি রয়েছে বলেই তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের দাবি।

সুব্রত তাঁর চিঠিতে মুকুলের কাছ থেকে হিসেবপত্র সংক্রান্ত নথি ছাড়াও রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে তৃণমূলের চিঠিচাপাটি, দলের রেজিস্ট্রেশনের আসল নথি, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে লেখা তাঁর চিঠির অনুলিপি এবং দলের দৈনন্দিন কাজকর্ম ও ভবিষ্যতের জন্য জরুরি নথি (হার্ড এবং সফট কপি, ই-মেল) চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। এর জবাবে মুকুল লিখেছেন, প্রত্যেক হিসেবসংক্রান্ত নথিরই একটি প্রতিলিপি ৩০বি, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের দলীয় কার্যালয়ের জনৈক

শ্রীচক্রবর্তীর কাছে রাখা আছে। এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হোক। দলের রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত নথিপত্র ওই কার্যালয়ের মানিক মজুমদারের কাছে রাখা আছে। মুকুলের চিঠিতে উল্লেখ করা এই দু’জনের সঙ্গে শুক্রবার রাতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কেউই ফোন ধরেননি।

তৃণমূলের অন্দরে নথি নিয়ে এই চাপানউতোরের মধ্যেই অবশ্য সুব্রত বক্সীকে নোটিস পাঠানোর তোড়জোড় চলছে সিবিআই দফতরে। সংস্থার সূত্রের খবর, আগামী সপ্তাহের গোড়ার দিকে তৃণমূল দফতরে নোটিস পাঠানো হবে। এই নোটিস পাওয়ার পরে দলের তরফে কে সিবিআইয়ের কাছে যাবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সুব্রতবাবুকে আড়াল করতে এর মধ্যে আসরে নেমেছেন খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি জানিয়েছেন, সিবিআই তাঁকেই প্রশ্ন করুক। দলের সভানেত্রী হিসেবে তিনিই সব জবাব দেবেন।

তৃণমূলের একাংশের আবার বক্তব্য, সিবিআইয়ের উচিত মুকুলকে জেরা করা। কারণ তারা যে সময়ের হিসেব চাইছে, তখন মুকুলই দায়িত্বে ছিলেন। ওই সব হিসেবের খুঁটিনাটি সুব্রত বক্সীর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। মুকুল অবশ্য বলেন, ‘‘ওই চেয়ারে বসে যে তথ্য বা নথি দেখাশোনা করতাম, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির পর এখন তা করব কী করে?’’ একই সঙ্গে তাঁর স্থলাভিষিক্তকে কটাক্ষ করে মুকুলের মন্তব্য, ‘‘আমি যদি ওই পদে থাকতাম আর অফিসের বাইরে থাকতাম তবে ফিরে সিবিআইকে একটি ফোন করতাম।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE