Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

শিল্প বেহাল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আসন খালি রাজ্যে

মোট আসন বাড়ছে। কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফাঁকা থেকে যাওয়া আসনের সংখ্যাও। জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ডের ওয়েবসাইটই জানান দিচ্ছে, শিল্পে পিছিয়ে পড়া বাংলায় এ বার প্রযুক্তিশিক্ষা থেকেও মুখ ফেরানোর ধুম। রাজ্যে এ বছর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মেরেকেটে ১৪ হাজার আসন ভরেছে। ৩৮ হাজার ১৩০টির মধ্যে ফাঁকা থেকে গিয়েছে ২৪ হাজার ১৫০টি আসন।

সাবেরী প্রামাণিক ও গার্গী গুহঠাকুরতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৪৫
Share: Save:

মোট আসন বাড়ছে। কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফাঁকা থেকে যাওয়া আসনের সংখ্যাও। জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ডের ওয়েবসাইটই জানান দিচ্ছে, শিল্পে পিছিয়ে পড়া বাংলায় এ বার প্রযুক্তিশিক্ষা থেকেও মুখ ফেরানোর ধুম।

রাজ্যে এ বছর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মেরেকেটে ১৪ হাজার আসন ভরেছে। ৩৮ হাজার ১৩০টির মধ্যে ফাঁকা থেকে গিয়েছে ২৪ হাজার ১৫০টি আসন। এখন কলেজে কলেজে কাউন্সেলিং চলছে। তাতেও কত আসন ভরবে, সে ব্যাপারে সন্দিহান উচ্চশিক্ষা দফতর। গত দু’-তিন বছরে ২০-২২ হাজারের বেশি ছাত্র ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হননি। এ বার সংখ্যাটা পৌঁছেছে তলানিতে।

গত ১ অগস্ট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির শেষ দফার কাউন্সেলিংয়ের পর বোর্ড জানিয়েছে, এ বার জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়েছিলেন ১ লক্ষ ২২ হাজার ছাত্রছাত্রী, যার মধ্যে মেধাতালিকায় নাম উঠেছিল ৭৭ হাজারের। ভর্তি হয়েছেন ১৪ হাজার। বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, যাদবপুর-শিবপুরেও খালি থেকে গিয়েছে বেশ কিছু আসন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এই অনীহার পিছনে অন্যতম কারণ হল রাজ্যে শিল্পের মলিন চিত্র এবং তার জেরে তৈরি হওয়া চাকরির আকাল।

জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ডের চেয়ারম্যান ভাস্কর গুপ্তের ব্যাখ্যা, এ বছর কাউন্সেলিং শুরু হতে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। রাজ্যের পাশাপাশিই চলেছে জাতীয় প্রবেশিকা-র কাউন্সেলিংও। তাই অনেকেই পছন্দের বিষয় পড়ার সুযোগ পাওয়ায় ভিন্ রাজ্যে চলে গিয়েছেন। যার জেরে রাজ্যের প্রতিষ্ঠানগুলিতে আসন খালি থেকে গিয়েছে। বাড়ছে উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার অনীহাও। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের খবর, এ বছর সাড়ে সাত লক্ষ ছাত্রছাত্রী ওই পরীক্ষা দিয়েছেন। তার মধ্যে বিজ্ঞান বিষয়ের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ১ লক্ষ ১৫ হাজার।

রাজ্য প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য সব্যসাচী সেনগুপ্ত, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য ও জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ দত্তের মতো প্রবীণ শিক্ষক থেকে মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ তুষার বসু সকলেই জানাচ্ছেন চাকরির সুযোগ পাওয়াই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের প্রাথমিক চাহিদা। কিন্তু ক্রমশ সেই জায়গাটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা, পরিকাঠামো, পছন্দের বিষয় পড়ার সুযোগ পাওয়াও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। সেগুলি পছন্দ না হলেও অনেকে অন্যত্র চলে যান। তবে এ রাজ্যের অবস্থা আলাদা করে খারাপ বলে অবশ্য মানতে নারাজ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “পশ্চিমবঙ্গ একা নয়। গোটা দেশেই এক অবস্থা।”

সামগ্রিক ভাবে দেশ জুড়ে শিল্পের হাল যে খারাপ এবং তার জেরে সার্বিক ভাবেই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার উৎসাহ যে কমছে, সেটা অবশ্য বিশেষজ্ঞরাও মানছেন। তথ্যই বলছে, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ চালু করার ক্ষেত্রে অগ্রণী রাজ্য কর্নাটকের কলেজেও আসন খালি। তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে যেখানে অটো শিল্প-সহ বিভিন্ন উৎপাদন শিল্পের বাড়বাড়ন্ত, সেখানেও স্নাতকোত্তর ইঞ্জিনিয়ারদের একটা বড় অংশ এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লেখাচ্ছেন। এই সংখ্যাটা চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১ লক্ষ ৫৯ হাজার। যা গত বছরের তুলনায় তিন গুণ।

কেন এমন হল? বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, দেশ জুড়েই নির্মাণ শিল্পে ভাটা। তার উপরে তথ্যপ্রযুক্তি, কম্পিউটার সায়েন্সের কর্মক্ষেত্রেও পুরনো জোয়ার নেই। ফলে গত বছর দশেক যাবৎ এই দু’টি বিষয় পড়ার যে চাহিদা তৈরি হয়েছিল, তা-ও গিয়েছে ঝিমিয়ে। নতুন পুঁজি ও নতুন প্রকল্পের অভাবে টান পড়েছে বেসরকারি সংস্থার নিয়োগে।

দীর্ঘদিন অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিকাল এডুকেশন (এআইসিটিই)-এর সঙ্গে জড়িত এক প্রবীণ শিক্ষক জানাচ্ছেন গোটা দেশে এখন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এর এক-তৃতীয়াংশ বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এআইসিটিই সূত্রের খবর, কয়েক বছর আগেও নতুন শিক্ষাবর্ষে হাজারখানেক নয়া প্রতিষ্ঠান খোলার আবেদন পৌঁছত তাদের কাছে। সেই সংখ্যা সম্প্রতি ১০০-রও নীচে নেমে গিয়েছে। এ রাজ্যে অবশ্য নতুন প্রতিষ্ঠান খোলার ঝোঁকে ভাটা পড়েনি। বরং এই শিক্ষাবর্ষেই যাত্রা শুরু করেছে দু’টি নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

কিন্তু সার্বিক ভাটার বাজারে পশ্চিমবঙ্গের হাল যে আলাদা করে শোচনীয়, সেটাও বলছেন বিশেষজ্ঞরা। রাজ্যের শিল্প মহলের মতে, দেশ জুড়েই শিল্পের ছবিটা রংচটা হলেও অন্য রাজ্যে কারখানার সংখ্যা বেশি। আর একসঙ্গে সব সংস্থার হাল খারাপ নয়। ফলে কয়েকটি সংস্থায় নিয়োগের সুযোগ তৈরি হচ্ছেই। কিন্তু এ রাজ্যে সেই সুযোগ একেবারে তলানিতে। এক দিকে জেসপ-হিন্দমোটর-ডানলপ-শালিমারের মতো ঐতিহ্যশালী কারখানায় তালা পড়েছে, চা শিল্প-চটশিল্পে আকাল চলছে। অন্য দিকে সিঙ্গুর পরবর্তী অধ্যায়ে এ রাজ্যে লগ্নিতে অনীহা তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার আগ্রহ তৈরি হবে কী করে, প্রশ্ন তুলছেন শিল্পকর্তারা। বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট কল্লোল দত্তের কথায়, “বিশ্বজোড়া মন্দার পরে ফিরে আসছিল মেকানিক্যাল, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার প্রবণতা। কিন্তু উৎপাদন শিল্পের অভাবে রাজ্যে কাজের সুযোগ কমছে। ফলে আসন খালি পড়ে থাকছে।”

বণিকসভা সিআইআই-এর ২০১২-১৩ সালের একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের আর্থিক বৃদ্ধির হারে উৎপাদন শিল্পের ভূমিকা নেহাতই কম। বৃদ্ধির হারে মাত্র ৮.৬% উৎপাদন শিল্পের দখলে রয়েছে। অর্থাৎ কোর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে যে সব ক্ষেত্রে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানেই পিছিয়ে আছে রাজ্য। রাজ্যের এক শিল্পকর্তার মতে, নতুন প্রকল্প (গ্রিনফিল্ড প্রজেক্ট) তৈরি না হলে সদ্য পাশ করা ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরি বাড়া সম্ভব নয়। পরিষেবা ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ৬৫ শতাংশ হলেও তাতে চাকরির সুযোগ তেমন বাড়ছে না। কারণ, এই ধরনের চাকরি মূলত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিতেই হয়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE