গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
রাজ্যে বাম শাসনের শেষদিকে প্রভূত আলোচিত হত ‘আমরা-ওরা’ শব্দবন্ধ। যা তৎকালীন শাসক শিবির ব্যবহার করত শাসক এবং বিরোধী বোঝাতে। প্রায় ১০ বছর পর আবার রাজ্য রাজনীতিতে ফিরে এসেছে সেই শব্দবন্ধ। তফাত— এ বার সেই আওয়াজ উঠেছে একটি দলের অন্দরে। বিজেপি।
নীলবাড়ি দখলের লড়াইয়ের আগে দলের অন্দরের ‘অস্বস্তি’ কিছুতেই কাটছে না বিজেপি-র। যত ভোটের টিকিট দেওয়ার সময় এগিয়ে আসছে, ততই সেই ‘অস্বস্তি’ প্রকাশ্যে এসে পড়ছে। তার মূলে রয়েছে চিরাচরিত আদি-নব্য দ্বন্দ্ব এবং সেই সূত্রে কোন কোন আসনে কারা কারা লড়বেন, সেই নিয়ে দাবি এবং জল্পনা। যা বিজেপি-র মতো একটি ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ’ দলে বেমানান বলে দলের নেতাদেরই একাংশ একান্ত আলাপচারিতায় স্বীকার করে নিচ্ছেন। তবে পাশাপাশিই তাঁরা জানাচ্ছেন, প্রার্থী বাছাই করবেন স্বয়ং অমিত শাহ। তখন দলের অন্দরে এই ধরনের দাবিদাওয়া আক্ষরিক অর্থেই ‘অস্তিত্বহীন’ হয়ে পড়বে। দিল্লি যা বলবে, সেটাই মেনে নিতে হবে। তবু ভিতরে ভিতরে যে একটা আওয়াজ উঠেছে, সেটা দলীয় শৃঙ্খলার পক্ষে খানিক অস্বস্তির বইকি।
বঙ্গ বিজেপি-তে আদি-নব্য বিবাদ অনেক দিন ধরেই চলছে। তৃণমূল ছেড়ে মুকুল রায় গেরুয়া শিবিরে আসার পরে অনেক সময়ই তাঁর সঙ্গে দিলীপ ঘোষের বিবাদ প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে। একাধিকবার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দুই নেতাকে একসঙ্গে নিয়ে বসেছেন। একসঙ্গে চলার নির্দেশও দিয়েছেন। ভোটের আগে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দু’জনকে একসঙ্গে চলার নির্দেশ দিলেও ভিতরে ভিতরে চাপা টেনশনটা পুরোপুরি যায়নি। সেই সূত্রেই আবার এসে পড়েছে ‘আদি’ ও ‘নব্য’ ভাগাভাগির সমীকরণ। যার মূলে রয়েছে গত লোকসভা ভোটের আগে-পরের হিসাবনিকাশ।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে ১৮ আসনে জয় পেয়েছিল বিজেপি। দলের হিসেবে সেই নির্বাচনের নিরিখে ১২১টি বিধানসভা আসনে তারা এগিয়ে রয়েছে। সেই সূত্রেই এখন রাজ্য বিজেপির ‘আদি’-দের একাংশ লোকসভা নির্বাচনের পরে যাঁরা দলে যোগ দিয়েছেন তাঁদের ‘নব্য’ হিসেবে ধরছেন। আর তাঁরাই আওয়াজ তুলছেন, গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করা নেতাদেরই এগিয়ে থাকা ১২১টি আসনে প্রার্থী করা হোক। যাঁরা পরে এসেছেন এবং এর পরেও আসবেন, তাঁরা লড়ুন বাকি ১৭৩ আসনে। এবং জিতে দেখান! ওই ‘আদি’ নেতাদের বক্তব্য, যে সব এলাকায় বিজেপি একাই জেতার মতো জায়গায় রয়েছে, সেখানে দলের নীতি আলাদা হোক। অনেক ক্ষেত্রে এমনও বলা হচ্ছে যে, তৃণমূল থেকে এমন অনেক নেতা বিজেপি-তে এসেছেন বা আসতে পারেন, যাঁদের সঙ্গে দলের কর্মীদের লড়তে হয়েছিল লোকসভা নির্বাচনে। যে প্রশ্ন উঠেছিল পাণ্ডবেশ্বরের বিধায়ক তথা আসানসোল পুরসভার প্রাক্তন প্রশাসক জিতেন্দ্র তিওয়ারির বিজেপি-তে যোগদানের জল্পনার সময়। তখন দলের একটা বড় অংশ প্রশ্ন তুলেছিলেন, আসানসোলে যখন বিজেপি পর পর দু’বার লোকসভা নির্বাচনে জিততে পেরেছে, তখন দলের এতটা ‘জিতেন্দ্র-নির্ভরতা’ কেন! অনেকে এমনও বলেন যে, লোকসভা নির্বাচনের সময় বিজেপি কর্মীদের মূল লড়াইটাই ছিল জিতেন্দ্রর বিরুদ্ধে! যদিও সেই প্রশ্ন বা যুক্তিকে আমল দেননি বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। জিতেন্দ্র নিয়ে প্রকাশ্যে ‘দলের বিরোধী’ মন্তব্য করায় শো-কজ করা হয়েছিল সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু, মহিলা মোর্চা সভানেত্রী অগ্নিমিত্রা পাল-সহ চার জনকে।
এর পর থেকে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খোলেননি। কিন্তু রাজ্য বিজেপি-র ‘আদি’ নেতাদের অনেকেই ঘনিষ্ঠ মহলে সরব। তেমনই এক নেতার কথায়, ‘‘লোকসভা নির্বাচনের হিসেব করলে সিঙ্গুর বিধানসভা এলাকায় বড় ব্যবধান ছিল সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়ের। এই ব্যবধান পাওয়ার জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের। সেই পরিশ্রমের সময় কেউ কেউ হয়তো ভেবে রেখেছিলেন, লড়াইয়ের পুরস্কার হিসেবে বিধানসভা ভোটে দলের টিকিট পাবেন। এমন আশা করা অন্যায় নয়। কিন্তু এখন যদি অন্য দল থেকে আসা কোনও নেতা সেই আসনে টিকিট পেয়ে যান, তা হলে কষ্ট তো হবেই। ক্ষোভও থাকবে।’’ ওই নেতার আরও বক্তব্য, ‘‘আমি সিঙ্গুরটা একটা উদাহরণ দিয়ে বললাম। এই বিষয়টা যে ১২১টা বিধানসভা আসনে আমরা ভাল ফল করেছিলাম, তার সর্বত্রই সত্যি। তা ছাড়াও অনেক বিধানসভা এলাকায় খুব কম ব্যবধানে আমরা পিছিয়ে ছিলাম। সেখানকার নেতাদেরও যদি টিকিট পাওয়ার আশা থেকে থাকে, তা হলে সেটা ন্যায্য।’’ প্রসঙ্গত, কিছুদিন আগেই গত বিধানসভা নির্বাচনে পূর্ব বর্ধমানের কালনার বিজেপি প্রার্থী নিউটন মজুমদার তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। যে সূত্রের দলের একাংশের অভিমত, সম্প্রতি কালনার তৃণমূল বিধায়ক বিশ্বজিৎ কুণ্ডু বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার পরে তাঁর আর টিকিট পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বুঝেই নিউটনের শিবিরবদল। ওই ঘটনাকে ‘উদাহরণ’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে ‘আদি’ শিবিরের একাংশ।
ওই ‘ক্ষোভ’ সম্পর্কে যে রাজ্য বিজেপি-র শীর্ষনেতৃত্ব ওয়াকিবহাল নন, তা নয়। তবে তাঁদেরও হাত-পা কার্যত বাঁধা। কারণ, বিধানসভা নির্বাচনের রাশ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হাতে। অমিত অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, ২৯৪টি আসনের প্রার্থী তিনিই বাছবেন। সেক্ষেত্রে ফর্মুলা হবে, কার জেতার ক্ষমতা রয়েছে। কে ‘আদি’ বা কে ‘নব্য’ তা নয়। অমিতের এই নীতির কথা ভেবে খানিক নিশ্চিন্ত ‘নব্য’রা। তাঁদের পক্ষপাতী এক নেতা যেমন বলছেন, ‘‘২০০-র বেশি আসন পেতে হলে অত ছুঁৎমার্গ থাকলে চলবে না। ক্ষমতায় আসতে গেলে ক্ষোভ-বিক্ষোভ নয়, জেতার সম্ভাবনাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার।’’ ওই নেতার আরও সংযোজন, ‘‘দীর্ঘদিন রাজ্যে অস্তিত্বহীন বিজেপি গত লোকসভা নির্বাচনে ভাল ফল করেছে এটা ঠিক। কিন্তু মনে রাখতে হবে, রাজ্যের ক্ষমতায় আসতে পারে এমন আশার ক্ষীণ আলোও অতীতে কখনও দেখেনি বিজেপি। কেন্দ্রীয় নেতারা এটা ভাল করেই জানেন, আড়ালে যে যা-ই বলুক, এই সময়ে দলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে উল্টো স্রোতে যাওয়ার মতো নির্বোধ কমই মিলবে।’’
তা হলে কি ‘আমরা-ওরা’ মিলেমিশে ‘আমরা’ হবে? রাজ্য বিজেপি-র কাছে অন্যতম বড় পরীক্ষা এখন সেটাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy