Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: দোষ কিন্তু সকলেরই

ওড়িশা এবং গুজরাত, মহারাষ্ট্র, অন্ধপ্রদেশ, তামিলনাড়ু-সহ অন্য রাজ্যের সরকার যে তৎপরতা দেখিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের সরকার এবং জনগণ তা দেখাতে পারেনি।

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:৩১
Share
Save

মোহিত রায়ের প্রবন্ধ ‘শিল্পও নয়, পরিবেশও নয়’ (২১-৩) প্রসঙ্গে কিছু কথা। নতুন শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী ওড়িশা এবং গুজরাত, মহারাষ্ট্র, অন্ধপ্রদেশ, তামিলনাড়ু-সহ অন্য রাজ্যের সরকার যে তৎপরতা দেখিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের সরকার এবং জনগণ তা দেখাতে পারেনি। পাশাপাশি যে দল যখন বিরোধীর ভূমিকা পালন করেছে, তারাও কিন্তু সরকারের ভাল কাজে সব সময় সহযোগিতা করেনি। তাই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে শিল্প স্থাপনের প্রচেষ্টার বিরোধিতায় সব বিরোধী পক্ষ জোটবদ্ধ আন্দোলন করেছিল এবং সঙ্গত করেছিলেন বিদ্বজ্জনেরা।

এই আত্মঘাতী আন্দোলনের দ্বারা সরকার পরিবর্তন সম্ভব হল ঠিকই, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের শিল্প স্থাপনের অনুকূল পরিবেশ বিঘ্নিত হল বলেই অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। অন্য দিকে, কেন্দ্রীয় সরকারের মাসুল সমীকরণের ফলে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পাট শিল্প, বস্ত্র শিল্প, ওষুধ শিল্প, এঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, কয়লা-ইস্পাত ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে এ রাজ্য ক্রমশ পিছিয়ে পড়ে। যখন নীতিটি রদ করা হল, তখন রাজ্যের বহু শিল্পে নাভিশ্বাস উঠেছে অথবা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। উগ্র শ্রমিক আন্দোলনও বহু শিল্পের নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিল। অসংখ্য লাভজনক কারখানার দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। সেগুলো পুনরায় খোলার উদ্যোগ রাজ্যের কোনও সরকার করেনি। কলকাতাকে লন্ডন, দার্জিলিংকে সুইটজ়ারল্যান্ড করার প্রক্রিয়া কতটা অগ্রসর, জানি না। তবে হাওড়ার বিস্তীর্ণ শিল্পাঞ্চলের ‘শেফিল্ড অব দি ইস্ট’ তকমা ফিরে এলেই যে মানুষ আরও বেশি খুশি হবেন, সন্দেহ নেই।

রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

অন্য কারণ

মোহিত রায়ের প্রবন্ধ ‘শিল্পও নয়, পরিবেশও নয়’ প্রসঙ্গে জানতে চাই যে, রাসায়নিক শিল্প স্থাপনের বিরোধিতা করা কি বেঠিক হয়েছিল? গত শতাব্দীতে যে দ্বীপ গড়ে উঠেছে, সম্পূর্ণ পলিনির্ভর, অত্যন্ত নরম মাটি দিয়ে তৈরি, যার ভাঙাগড়া আরও অনেক দিন চলবে, তাতে এত বড় শিল্প কী ভাবে হত তার উল্লেখ নেই প্রবন্ধে। শুধু গুজরাতে দহেজ-এর উদাহরণ দেখিয়ে নয়াচরে ফস্কে যাওয়া শিল্প নিয়ে দুঃখ রয়েছে। তবু ভাল, দহেজে ‘বালিয়াড়ি’ আর ‘রুক্ষ’ জমির উল্লেখ করেছেন, নয়াচর দ্বীপের সঙ্গে যার কোনও মিল নেই।

নয়াচরের মানুষ নয়, ভয় পেয়েছিলেন হুগলি নদীর মোহনা থেকে হাওড়া জেলা পর্যন্ত কয়েক লক্ষ গরিব মৎস্যজীবী। তাঁরা জোয়ার ভাটার নদীতে মাছ ধরেন। ব্লিচিং বা রঙের কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য থেকে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপুল পরিমাণ ছাই— সবই এসে তাঁদের জীবিকায় থাবা বসায়। পেট্রোরসায়ন শিল্পের বর্জ্য অথবা দুর্ঘটনার পরিস্থিতি কী অভিঘাত তৈরি করে, জানতে তাঁরা অনেক আবেদন নিবেদন করেছিলেন। আর হুগলি নদী কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের কয়েক কোটি মানুষের পানীয় জলের উৎস, আরও বেশি সংখ্যক মানুষের চাষের জমিতে সেচের জলের উৎস। ফলে, বহু সাধারণ মানুষের কাছেও রাসায়নিক শিল্পজনিত জলদূষণের প্রশ্নটি জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কেউ সদুত্তর পাননি। অতএব, অনেকেই বিদ্বজ্জনদের লিখতে বলেছিলেন। তাতেই লেখকের আপত্তি! পুস্তিকার প্রথম ৫০ পৃষ্ঠায় কেন নয়াচরের কথা নেই, কেন আছে পেট্রোরসায়ন শিল্প কী এবং তা থেকে কী দূষণ হতে পারে তার কথা! সত্যি তো— বিদ্বজ্জনের বিষয় বিদ্বজ্জনের মধ্যেই থাকা উচিত। সাধারণ মানুষকে জানানো কেন?

বিদ্বজ্জনের আপত্তি, মৎস্যজীবীদের প্রতিবাদে নয়াচরে শিল্প বন্ধ হয়েছিল— বিষয়টা তা নয়। লেখক আসল কারণ ঝাপসা ভাবে উল্লেখ করেছেন। ১৯৯১-এ কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ মন্ত্রক কোস্টাল রেগুলেশন জ়োন নোটিফিকেশন (উপকূলীয় নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল বিজ্ঞপ্তি) দ্বারা উপকূল অঞ্চল, যে সব এলাকায় জোয়ার ভাটা খেলে— সেখানে উন্নয়ন, নির্মাণ, জীবনযাপন নিয়ে নির্দেশিকা ও বিধিনিষেধ তৈরি হয়। নয়াচরের সম্পূর্ণটাই উপকূলীয় নিয়ন্ত্রণবিধির আওতায় থাকার কথা ছিল। শিল্পস্থাপনের উদ্দেশ্যে নয়াচরের ও তার বিভিন্ন অংশের চরিত্র চিহ্নিত এবং বদল করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার বহু চেষ্টাও করে। তা সত্ত্বেও ছাড়পত্র মেলেনি। প্রস্তাবিত পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের খসড়া প্রস্তাবে লেখা হয় সবই সিআরজ়েড নিয়ম মেনে করা হবে। কোন নিয়ম মেনে কী ভাবে করা হবে লেখা হয়নি। লেখক লিখেছেন, “উপকূল নিয়ন্ত্রণ আইনের জন্য প্রকল্পের কিছু বিশেষ ব্যবস্থা দরকার হতে পারত...।” নিয়মনীতির দুর্বলতা ফাঁকফোকর ব্যবহার করে নিষেধাজ্ঞাকে অনুমতিতে রূপান্তর করা উচিত? লেখক মন্তব্য রেখেছেন, “এতে বিদেশি অর্থের প্রভাব আছে বলেই মনে করা হয়।” কোন বিদেশি ভাল আর কোন বিদেশি খারাপ— নির্ধারণ করা কি তাঁর কাজ? তা ছাড়া লেখক-মতে, যাঁরা পেট্রো-রসায়ন শিল্পের বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের অনেকে তৃণমূল সরকারের প্রসাদধন্য। বোধহয় ভুলে গিয়েছেন, বা মনে থাকলেও চেপে গিয়েছেন যে, তৃণমূল ক্ষমতায় এসে ২০১২ সালে ওই নয়াচরেই আমদানিকৃত কয়লানির্ভর সুপার-ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করতে উদ্যোগী হয়। ২০১২ থেকে ২০১৪ এই নিয়ে হইচই চলে। ইউনিভার্সাল ক্রেসেন্ট পাওয়ার প্রাইভেট লিমিটেড ১২০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। নয়াচরে অনেক বিজ্ঞপ্তি, সাইনবোর্ড টাঙানো হয়। ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আসার কথা হয়। কেন্দ্রীয় স্তরে প্রস্তাব যায়। তখনও জোয়ার-ভাটায় নদীতে মাছ ধরা মৎস্যজীবীরা ক্ষীণ কণ্ঠে আপত্তি তোলেন। কিন্তু সেই আপত্তির খবর বেশি না রেখেও, কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির বিশেষজ্ঞ দল পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের বিচারে প্রকল্পটি ২০১২ সালেই খারিজের পরামর্শ দেয়। পাশাপাশি ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের মামলায় পরিবেশ মন্ত্রকের এক্সপার্ট অ্যাপ্রেজ়াল কমিটি ও তাদের নিয়োজিত বিশেষজ্ঞ দলের প্রতিবেদন গুরুত্ব পায়। এনজিটি-ও প্রকল্পের বিরুদ্ধে রায় দেয়। নয়াচরে সুপার-ক্রিটিক্যাল কয়লাশিল্প বাতিল হয়। পুরনো সংবাদপত্রে খবরটি, বিশেষজ্ঞ দলের সুপারিশ ও এনজিটি-র রায়গুলোও দুর্লভ নয়।

অর্থাৎ, নয়াচরে বৃহৎ শিল্পের পরিকল্পনা পরিবেশের পরীক্ষায় ডাবল ফেল করেছিল। এনজিটি-র রায়কে আলাদা করে মান্যতা দিলে ফেলের হ্যাটট্রিক। তাতে পরিবেশের কিঞ্চিৎ লাভ হলেও, বহু পেশাজীবীর অনেকটা অসুবিধা হয়েছিল। কাদের অসুবিধা, সে অন্য বিষয়।

সঞ্চারী চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-১৫

প্রশ্ন থাকছে

মোহিত রায়ের প্রবন্ধ ‘শিল্পও নয়, পরিবেশও নয়’ প্রসঙ্গে কিছু কথা। কলিঙ্গনগরে স্থানীয়রা দীর্ঘ দিন গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়েছেন। কিন্তু যখন গুলি চালিয়ে ১৩ জনকে (সরকারি হিসাব) হত্যা করা হল, কোনও দল কিছু করল না। গ্রামবাসীরা সর্বহারা হলেন। সেটা সিঙ্গুরে হয়নি কেন, এটাই লেখকের দুঃখ? কলিঙ্গনগরে টাটারা এত দিন অপেক্ষার পর ইস্পাত কারখানা করল, অথচ সিঙ্গুর থেকে পত্রপাঠ পাততাড়ি কেন গোটাল— লেখক বিস্মিত। আমাদের বিস্ময়, এত বছর ধরে সিঙ্গুরে যে প্রকল্প চালুর প্রস্তুতি চলল, প্রস্থানের দু’বছরেই, গুজরাত থেকে সে গাড়ি বাজারে এল কী করে? আর লেখকের স্বপ্নের মডেল রাজ্যের এত মানুষ, ঘটিবাটি বিক্রি করে আমেরিকায় দৌড়চ্ছে কেন?

আশিস সেনগুপ্ত, কলকাতা-৩৭

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Singur Nandigram Economy

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}