এই গাড়িতেই ছিলেন শাহজাহান শেখ। বৃহস্পতিবার। ছবি: সারমিন বেগম।
ধৃত শেখ শাহজাহানকে কলকাতার ভবানী ভবনে রাজ্য পুলিশের সদর দফতরে নিয়ে এল পুলিশবাহিনী। বসিরহাট আদালত থেকে সরাসরি সন্দেশখালিকাণ্ডে ধৃত তৃণমূল নেতাকে ভবানী ভবনে নিয়ে আসা হয়। সংবাদমাধ্যমের চোখে ধুলো দিয়ে বসিরহাট থেকে বেরিয়ে বাসন্তী হাইওয়ে ধরে ঘটকপুকুর, ভোজেরহাট পেরিয়ে সায়েন্স সিটি পেরিয়ে শাহজাহানকে কলকাতায় নিয়ে এসেছে পুলিশ। যে ভাবে তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে, ওই পরিকল্পনা আগে থেকেই করা ছিল। গোটা রাস্তা কার্যত যানবাহন শূন্য করে দেওয়া হয়েছিল। একপ্রকার ‘গ্রিন করিডর’ গড়ে বিনা হইচইয়ে শাহজাহানকে নিয়ে ভবানী ভবনে পৌঁছয় রাজ্যপুলিশ। আগামী ১০ দিন তাঁকে সেখানেই রাখা হবে। সেখানেই তাঁকে দফায় দফায় জেরা করবেন রাজ্যপুলিশের পদস্থ অফিসারেরা।
বসিরহাট আদালত থেকে বেরোনোর খানিক পরেই সংবাদমাধ্যমের চোখে ধুলো দিয়ে শাহজাহানকে নিয়ে পুলিশের তিনটি গাড়ির কনভয় উধাও হয়ে যায়। দু’টি সাদা। একটি ধূসর রঙের। তিনটিই এসইউভি। তিনটিরই সামনে-পিছনে ‘পুলিশ’ লেখা স্টিকার রয়েছে। সাদা রঙের গাড়িটিতেই ছিলেন ধৃত শাহজাহান। সেটির মাথায় ছিল নীলবাতি। শাহজাহানকে মাঝের আসনের মাঝখানে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। তাঁর দু’পাশে ছিলেন পুলিশের উর্দিধারী অফিসারেরা। খুঁজতে খুঁজতে হাইওয়েতে সেটির হদিস পায় আনন্দবাজার অনলাইন। তার পর সেই সংক্ষিপ্ত কনভয়ের সঙ্গেই বসিরহাট থেকে কলকাতার ভবানী ভবন পর্যন্ত আসি আমরা।
কেন এমন করা হল, তা নিয়ে বিবিধ মতামত রয়েছে। তবে তার মধ্যে সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি হল, সংবাদমাধ্যম এবং এলাকার লোকের নজরের বাইরে শাহজাহানকে রেখে নির্বিঘ্নে জেরা করা। যদিও বিরোধীরা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন যে, সন্দেশখালিকাণ্ডে ধৃতকে এর পরে নাকি এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে রাখা হবে। বস্তুত, সেই মর্মে বুধবার টুইটও করেছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।
বৃহস্পতিবার আদালত থেকে পুলিশের গাড়িতে সওয়ার শাহজাহান আচমকাই উধাও হয়ে যান। বসিরহাট আদালত থেকে শাহজাহানকে নিয়ে বার হয় ৭-৮টি গাড়ির কনভয়। কিন্তু দু’কিলোমিটার রাস্তা পেরোনোর পর বসিরহাট রেলগেটের সামনে আচমকাই শাহজাহান-সহ পুলিশের গাড়ির কনভয়ের মাঝখানে ঢুকে পড়ে একটি গাড়ি। পুলিশবাহিনী অন্য গাড়ি থেকে নেমে সেই গাড়িটি সরানোর আগেই শাহজাহানকে নিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় পুলিশের দু’টি গাড়ি।
কী ভাবে ঘটল ঘটনা?
শাহজাহানকে গ্রেফতারির শুরু থেকেই চূড়ান্ত গোপনীয়তা নিয়েছে পুলিশ। প্রথমত, গ্রেফতারির পর শাহজাহানকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়নি। ভোরবেলায় সরাসরি তাঁকে বসিরহাটের কোর্ট লক আপে আনে পুলিশ। বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হওয়া পর্যন্ত সেখানেই বসিয়ে রাখা হয়েছিল তাঁকে। সেই সঙ্গে গোটা এলাকাটি ঘিরে রেখেছিল র্যাফ এবং পুলিশবাহিনী। কারণ, শাহজাহান গ্রেফতারির খবর পাওয়ার পরই এলাকায় ভিড় করেছিলেন প্রচুর মানুষ। হাজির হয়েছিল সংবাদমাধ্যম। অন্য দিকে, শাহজাহানের গ্রেফতারির খবর দিয়ে যে সাংবাদিক বৈঠকটি করেন এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার, সেটি তিনি বসিরহাটে করেননি। বদলে করেন মিনাখাঁয়। যাতে সকলের নজর থাকে সে দিকে।
পাশাপাশিই, শাহজাহানকে নিয়ে মামলার শুনানি বেলা ১২টা থেকে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা আচমকাই দু’ঘণ্টা এগিয়ে আনা হয়। সকাল ১০টায় শুনানি শুরু করে কয়েক মিনিটের মধ্যেই তা শেষ করে দেওয়া হয়। দ্রুত শাহজাহানকে নিয়ে বেরিয়ে আসে পুলিশ। বাইরে কনভয় প্রস্তুত ছিল। কয়েক মিনিটের শুনানি শেষে শাহজাহানকে নিয়ে কনভয়ের দিকে এগিয়ে আসে পুলিশ। দ্রুত রওনা হয় পুলিশের কনভয়। কনভয়ে শাহজাহানের গাড়ির আগে-পরে একটি করে পুলিশের গাড়ি। তার পরে বাকি গাড়িগুলি। কনভয়ের একেবারে পিছনে ছিল সংবাদমাধ্যমের একাধিক গাড়ি।
বসিরহাট আদালত থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে যখন শাহজাহানকে নিয়ে পুলিশের গাড়ির কনভয় বসিরহাট রেলগেটের কাছে তখনই আচমকা একটি অন্য গাড়ি ঢুকে পড়ে কনভয়ের মাঝখানে। ফলে শাহজাহান-সহ পুলিশর তিনটি গাড়ি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বাকি কনভয় থেকে। পুলিশ যখন গাড়ি থেকে নেমে কনভয়ে ঢুকে পড়া গাড়িটিকে সরাতে ব্যস্ত, তত ক্ষণে ৫-৭ মিনিট কেটে গিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ওই সময় শাহজাহানকে নিয়ে পুলিশের গাড়ি বেরিয়ে যায়। সংবাদমাধ্যমের চোখের আড়ালে চলে যান শাহজাহান।
কেন শাহাজাহানকে নিয়ে গোপনীয়তা?
কারণ, শাহজাহানকে কোথায় রাখা হচ্ছে, তা জানতে দিতে চাইছে না পুলিশ। প্রথমত, শাহজাহানকে ঘিরে জনরোষের আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে শাহজাহানকে সামলাতে বসিরহাট আদালতে যেমন বড় সংখ্যক পুলিশবাহিনী এবং র্যাফ মোতায়েন করা হয়েছিল, ঠিক ততটা বা তারও বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে পুলিশি হেফাজতে-রাখা শাহাজাহানকে নিয়েও। শাহজাহানকে নিয়ে সন্দেশখালিতে এখনও অশান্তি চলছে। সেই আবহে আরও একটি জায়গায় যদি বিশাল পুলিশবাহিনী মোতায়েন করতে হয়, তবে সন্দেশখালি এলাকা রক্ষীহীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। যার অবকাশে সেখানে আবার আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, শাহজাহানকে স্থানীয় কোনও থানায় রাখা হলে সেখানে সংবাদমাধ্যম নিয়মিত উপস্থিত থাকবে। শাহজাহানকে কোথায় কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ঘটনার পুনর্নির্মাণ হচ্ছে কি না, কারা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসছেন, বাড়ির কেউ দেখা করতে আসছেন কি না, সে সব কিছু সর্বসমক্ষে ঘটবে। মূলত সেই কারণেই শাহজাহানকে নিয়ে এই ‘গোপনীয়তা’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy