মৃত শ্যামল রায়ের ছেলে সুদেব। ধূপগুড়ির বাড়িতে। নিজস্ব চিত্র
জাতীয় নাগরিক পঞ্জিই (এনআরসি) কি ঘুম কেড়ে নিয়েছিল উনচল্লিশ বছরের অন্নদা রায়ের? না হলে সে দিন সকালে উঠে তড়িঘড়ি কেন চলে যাবেন স্টেশনে! সঙ্গে নিলেন গামছাখানা। সেটাই গলায় বেঁধে ঝুলে পড়লেন ওভারব্রিজ থেকে!
শনিবার ময়নাগুড়িতে অন্নদাদের বাড়ির দাওয়ায় একের পর এক অতিথি। এই আসছেন স্থানীয় বিশিষ্টরা, তো ওই আসছেন বিধায়ক। ওই বাঁশের বেড়ার ঘর আর দাওয়া কোনও দিন একসঙ্গে এত মান্যগণ্য লোক দেখেনি। মাটিতে বসে অন্নদার বাবা-মা। বাবা অমূল্যই অশৌচ পালন করছেন। চোখে জল। বলছিলেন, ‘‘একবার আমার নাম বাদ গিয়েছিল ভোটার তালিকা থেকে। এ বারেও অন্নদা নাকি গিয়ে আমার নাম দেখতে পায়নি। তার পরই ও খুব ভয় পেয়ে যায়।’’ পাড়া-পড়শিরা বলেন, অসমে এনআরসি তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই অন্নদা আতঙ্কে ভুগছিলেন।
অসমে নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের আগে থেকেই পড়শি উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল। পাশাপাশি রাজ্য, ফলে সেখানকার কথা চট করে এখানে চলে আসে। সে ভাবেই অসমে এনআরসি নিয়ে সেখানকার নেতাদের হাঁকডাকও কিছু কিছু জানতে পেরেছেন উত্তরবঙ্গের লোকেরা। তার উপরে এখানকার অনেক মেয়েরই বিয়ে হয়েছে অসমের বিভিন্ন জায়গায়। তাঁদের বেশ কয়েক জনের নাম ছিল না খসড়া এনআরসি তালিকায়। সর্বোপরি, দেশভাগের পরে ওপার বাংলা থেকে অনেকেই এসে ভিটে বানিয়েছেন এপারে। সব মিলিয়ে, বিস্তর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে কোচবিহার থেকে মালদহ, সব জায়গাতেই। ময়নাগুড়ির অন্নদা সেই চাপ নিতে পারেননি, বলছেন তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরা। একই ভাবে তাঁরা এনআরসি নিয়ে আঙুল তুলছেন বালুরঘাটের মন্টু সরকার বা ইটাহারের সোলেমান সরকারের মৃত্যুতেও।
বুধবারই হিঙ্গলগঞ্জে আচমকা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন তসলিমা বিবি। আধার কার্ড নিয়ে স্বামীর সঙ্গে তর্কাতর্কি করেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে জানা গিয়েছে। আগের দিনও উত্তরবঙ্গে চার জনের মৃত্যুর সঙ্গে জুড়ে ছিল এনআরসি-আতঙ্ক। ধূপগুড়ির শ্যামল রায়, কোচবিহারের আর্জিনা বিবি, জলপাইগুড়ির সাবের আলি, দিনহাটার সামসুল হক সেই আতঙ্কের ‘বলি’ বলে অভিযোগ। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষও বললেন, “অসমে বিজেপি যা করছে এবং বিজেপি’র নেতারা এনআরসি নিয়ে যে ভাবে হুমকি দিচ্ছেন, তাতে আশঙ্কিত সাধারণ মানুষ।’’
দিনদিন তাই ভিড় বাড়ছে সরকারি দফতরে। ভোটার তালিকা যাচাইয়ের কাজ এখন রাজ্যের সর্বত্রই হচ্ছে। কাজ হচ্ছে ডিজিটাল রেশন কার্ড তৈরিরও। সেই সব ক্ষেত্রে সরকারি দফতরগুলিতে উপচে পড়ছে ভিড়। বস্তুত বালুরঘাটে চড়া রোদের মধ্যে তেমনই এক লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যান মন্টু সরকার। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘‘বিজেপি নেতাদের হুমকির জন্যই নথি সংগ্রহে হুড়োহুড়ি চলছে।”
অসমের সঙ্গে যাঁদের আত্মীয়তার যোগ রয়েছে, তাঁরাই বলছেন, অনেকের ক্ষেত্রে নথি জোগাড়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। অনেকের ক্ষেত্রে নথি মেলেনি। বহু মানুষের আবার নথি পেলেও তার ভিত্তিতে নাম ওঠেনি তালিকায়। উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট জনেদের একাংশ বলছেন, ‘‘অসমে নাম তোলার ক্ষেত্রে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, সেটাই চিন্তায় ফেলেছে উত্তরবঙ্গের মানুষদের। তার উপরে বাদের তালিকায় যেমন সাধারণ হিন্দু বা মুসলিম বাঙালি রয়েছেন, তেমনই আছে গোর্খা বা অন্য জনজাতিও। তাই উদ্বেগটা ছড়িয়েছে সকলের মনে।’’
বিজেপি-বিরোধীদের অভিযোগ, হাজার আশ্বাস সত্ত্বেও লাখখানেক গোর্খার নাম নেই অসমের এনআরসি তালিকায়। নাম নেই বহু রাজবংশীরও। গোর্খাদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, গুয়াহাটি গিয়ে এ নিয়ে বৈঠক করতে হয়েছে দার্জিলিঙের সাংসদ রাজু বিস্তা ও বিধায়ক নীরজ জিম্বাকে। এখানে পাহাড়ে এসে আশ্বাস দিতে হয়েছে, গোর্খাদের কাউকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে না। উত্তরবঙ্গের রাজবংশীরা কিন্তু বিজেপির মতোই এনআরসি-র পক্ষে। কিন্তু অসমে এনআরসি তালিকা দেখার পরে তাঁরাও চিন্তিত।
বিজেপি অবশ্য পাল্টা দাবি করেছে, বিরোধীরা, বিশেষ করে তৃণমূল এই নিয়ে রাজনীতি করছে। বিজেপির কোচবিহার জেলা সভানেত্রী মালতী রাভা বলেন, “তৃণমূল রাজনৈতিক ফায়দার জন্য মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে।” একই কথা বলেছেন রায়গঞ্জের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরীও। বিজেপির অন্দরের খবর, সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটে উত্তরবঙ্গে যে গেরুয়া ঝড় দেখা গিয়েছে, এনআরসি আতঙ্কে তা কিছুটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে। সেটাই সামলানোর চেষ্টা চলছে। তাই দেবশ্রী বলেছেন, ‘‘যাঁরা এ দেশের মুসলমান, তাঁরা এখান থেকে যাবেন না। হিন্দুদের ক্ষেত্রে এনআরসি কোনও ভাবেই হবে না। তবে যারা অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশ-পাকিস্তানি বা রোহিঙ্গা, তাদের তাড়াতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy