—ফাইল ছবি।
তৃণমূলের নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার জানিয়েছেন, শান্তনু সেন ‘দলবিরোধী কাজ’ করেছেন। তাই তাঁকে সাসপেন্ড (নিলম্বিত) করা হয়েছে। কী সেই দলবিরোধী কাজ, তা জয়প্রকাশ প্রকাশ্যে জানাননি। শান্তনু জানিয়েছেন, তিনিও জানেন না, কোন দলবিরোধী কাজের জন্য তাঁকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তিনি দলের তরফে আনুষ্ঠানিক কোনও চিঠিও পাননি। বিষয়টি জেনেছেন সংবাদমাধ্যম থেকে।
জয়প্রকাশ না বললেও তৃণমূলের অন্দরে কী কারণে শান্তনুর শাস্তি, তা নিয়ে খুব সংশয় নেই। দলীয় সূত্রের খবর, ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সেবাশ্রয়’ কর্মসূচিতে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত থাকার কারণেই শান্তনুকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কারণ, প্রশাসনের একটি বড় অংশ মনে করছে, ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে ওই কর্মসূচি আসলে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ‘সমান্তরাল ব্যবস্থা’ গড়ে তোলার প্রয়াস। যদিও তা কেউই প্রকাশ্যে বলছেন না। এমন সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অভিষেকের ঘনিষ্ঠ সূত্রেও।
তৃণমূলের অন্দরে শান্তনু ‘অভিষেক-ঘনিষ্ঠ’ হিসাবেই পরিচিত। তিনি তা খুব একটা গোপনও করেন না। শান্তনুর বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ আসলে ঘুরিয়ে অভিষেককেই ‘বার্তা’ বলেও দলের অন্দরে জল্পনা শুরু হয়েছে। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতা যেমন বলেছেন, ‘‘শান্তনু দলের তরফে চিকিৎসক সংগঠনের নেতা। দল তাঁকে সেই দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু তিনি দলকে না জানিয়ে দলের দেওয়া পদ ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট কর্মসূচির জন্য চিকিৎসকদের এক জায়গায় এনেছেন।’’
শাস্তির পরেও শান্তনু অবশ্য ‘সেবাশ্রয়’ কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত থাকাকে ‘অন্যায়’ বলে মনে করছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘আমি দীর্ঘ দিন ধরে চিকিৎসক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। এ বারেও আইএমএ-র নির্বাচনে সিপিএম-বিজেপি এবং আমাদের দলেরও একটি অংশের সঙ্গে লড়ে জিতেছি। এর আগে যেখানে যেখানে আমাদের চিকিৎসা পরিষেবা দিতে বলা হয়েছে, যেমন আয়লা বা বুলবুল বা আমপানের সময়ে, আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছি। ফলে ‘সেবাশ্রয়’-এর জন্য কয়েক জন চিকিৎসককে জোগাড় করে দেওয়ায় অন্যায় কোথায়?’’ বস্তুত, এক ধাপ এগিয়ে শান্তনু বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যে ২৪ তারিখ চিকিৎসকদের নিয়ে সমাবেশ করবেন, সেখানেও আমি আমার পরিচিত চিকিৎসকদের যেতে বলব।’’ পাশাপাশিই তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘আমি তো বুঝতেই পারছি না, দলবিরোধী কী কাজ করলাম!’’
শান্তনুর আরও বক্তব্য, ‘‘আমি বুঝেই উঠতে পারছি না, দলের বিরুদ্ধে কী করলাম! সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দলের কথা ভেবেছি। পেশার (ডাক্তারি) কাজের বাইরে কেবল তৃণমূলের কাজ করেছি। তার পরেও কেন এই পদক্ষেপ করা হল বুঝতে পারছি না।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘কোনও দুর্নীতিতে আমার নাম জড়ায়নি। ইডি-সিবিআই আমার বাড়িতে ‘রেড’ও করেনি। আমার কোন কাজটি দলবিরোধী হিসাবে বিবেচিত হল, সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না। সেটা জানতে পারলে ভাল হয়। তবে দলীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে। আমি এখনও তৃণমূলে আছি। আমি এখনও তৃণমূলের অনুগত সৈনিক।’’
আরজি করের ঘটনা নিয়ে যখন রাজ্য তোলপাড়, তখন তৃণমূলের মুখপাত্র তথা চিকিৎসক নেতা শান্তনুই অভিযোগ তুলেছিলেন হাসপাতাল প্রশাসনের অন্দরে দুর্নীতির। সেই পর্বেই শান্তনুকে দলের ‘মুখপাত্র’ পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিল তৃণমূল। আরজি কর আন্দোলন এখন অতীত। সেই সময়ে শান্তনুকে দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে নিলম্বিত করল তৃণমূল।
গত ২ জানুয়ারি থেকে ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল সাংসদ অভিষেকের উদ্যোগে ‘সেবাশ্রয়’ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। টানা আড়াই মাস ধরে ওই লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভা এলাকায় সাত দফায় চলবে ওই স্বাস্থ্য শিবির। সেখানে কাজ করছেন প্রায় ১,৫০০ চিকিৎসক। যাকে অনেকেই ব্যাখ্যা করছিলেন আরজি কর পর্বের পরে চিকিৎসক মহলের সঙ্গে ‘সেতুবন্ধন’ করার প্রয়াস হিসেবে। ওই বিপুল পরিমাণ চিকিৎসককে একত্র করার কাজে তিনি যে ‘মুখ্য’ ভূমিকা নিয়েছিলেন, শান্তুনু নিজেই তা জানিয়েছিলেন। বস্তুত, ২ জানুয়ারি ওই কর্মসূচির শুরুর সময় শান্তনু সশরীরে সেখানে হাজির ছিলেন কি না, তা নিয়ে স্বাস্থ্য প্রশাসন থেকে খোঁজ নেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে খোঁজ নেওয়া হয়েছিল, কোন কোন চিকিৎসক ওই কর্মসূচির উদ্বোধনে গিয়েছেন। কোন কোন রাজনীতিকই বা উপস্থিত ছিলেন। শান্তনু সেদিনই জানান, তিনি সশরীরে ডায়মন্ড হারবারে না থাকলেও পুরো কর্মসূচির সঙ্গে পুরোপুরি জড়িত।
উত্তর কলকাতার টালা এলাকার শান্তনুর ‘ঘনিষ্ঠ’ এক নেতা শুক্রবার পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘উনি তো নিজের জন্য কিছু করেননি। তিনি যে নেপথ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন, সেটা ডায়মন্ড হারবারের জন্য। সেখানকার সাংসদ অভিষেক। তিনিই কিন্তু দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে কোনও কাজে সাহায্য করা কি দলবিরোধী কাজ?’’ ওই নেতার প্রশ্ন, ‘‘দু’দিন আগেই উত্তর কলকাতা তৃণমূলের পিকনিকে দাদাকে চিঠি পাঠিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যিনি চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তিনি দলীয় পদেই রয়েছেন। দলবিরোধী কাজ করে থাকলে পিকনিকে ডাকা হল কেন?’’
তৃণমূলের অন্য একটি অংশ অবশ্য ভিন্ন কারণ বলছে। এক নেতার কথায়, ‘‘শান্তনুকে মুখপাত্রের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তিনি নানা রাজনৈতিক বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। যাকে ‘শৃঙ্খলাভঙ্গ’ হিসাবে দল ধরে থাকতে পারে।’’
ভাঙড়ের তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামকেও একই সঙ্গে সাসপেন্ড করেছে তৃণমূল। ঘটনাচক্রে, আরাবুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন দলীয় সমীকরণে অভিষেকের ‘আস্থাভাজন’ বলে পরিচিত ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক শওকত মোল্লা। যদিও তৃণমূলের প্রথম সারির নেতৃত্ব একান্ত আলোচনায় বলছেন, আরাবুলের বিরুদ্ধে শুধু শওকতের অভিযোগ ছিল না, স্থানীয় স্তর থেকেও নানা অভিযোগ আসছিল। ঘটনাচক্রে, ভাঙড় এলাকার সাংগঠনিক বিষয় দেখারশোনার ভার দলের তরফে দেওয়া রয়েছে শওকতকেই। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঘনিষ্ঠ’ এক নেতার বক্তব্য, ‘‘আরাবুল ওখানে দলকে ডিস্টার্ব করছে। ২০২১ সালে এই দলাদলির কারণে ভাঙড়ে আমরা হেরেছিলাম। কয়েক দিন আগে ভাঙড়ে কয়েক হাজার মানুষকে নিয়ে সেখানকার আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি রক্তদান উৎসব করেছিলেন। এই সময়ে পার্টিকে রক্ষা করতে হলে আরাবুলের বিরুদ্ধে দলীয় স্তরে ব্যবস্থা নিতেই হত।’’
আরাবুল এর আগেও সাসপেন্ড হয়েছিলেন। পরে তিনি দলের মূলস্রোতে ফিরে এসেছিলেন। লোকসভা ভোটের আগে একটি মামলায় আরাবুলকে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশ। ভোটের সময়ে তিনি ছিলেন জেলবন্দি। মাস দুয়েক আগে তিনি জামিন পান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy