চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সুর বদলে গেল মুকুল রায়ের। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন তখন রেলের অধীনস্থ সংস্থা আইআরসিটিসি-র সঙ্গে সারদা গোষ্ঠীর চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পরে সোমবার তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বিষয়টিকে গুরুত্বহীন বলে সিবিআইয়ের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়েছিলেন। মঙ্গলবার সেই মুকুলবাবুই বিষয়টি নিয়ে তদন্তের পক্ষে সায় দিলেন। পাশাপাশি তিনি এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, মমতা রেলমন্ত্রী থাকাকালীন সারদার সঙ্গে আইআরসিটিসি-র যে বাণিজ্যিক চুক্তি হয়েছিল, পরবর্তী রেলমন্ত্রী হিসেবে তার দায় তিনি নেবেন না। মুকুলবাবুর কথায়, “ওটা যে সময়ের ঘটনা তখন আমি রেলমন্ত্রী ছিলাম না।”
রেল মন্ত্রক সূত্রের খবর, আইআরসিটিসি-র (ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশন) দফতর থেকে ইতিমধ্যেই এই চুক্তি সংক্রান্ত নথিপত্র জোগাড় করেছে সিবিআই। জানা গিয়েছে, ২০১০ সালে দক্ষিণ ভারতে ‘ভারত তীর্থ’ ট্রেন চালানোর জন্য আইআরসিটিসি-র সঙ্গে সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলসের চুক্তি হয়। রেল বোর্ডের এক সদস্যের সামনে ওই চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির জন্য কারা উদ্যোগী হয়েছিলেন, তা তদন্ত করবে সিবিআই।
রেল সূত্রে বলা হচ্ছে, তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা করা ট্রেন চালানোর জন্য বিভিন্ন বেসরকারি পর্যটন সংস্থার সঙ্গে আইআরসিটিসি-র চুক্তি হয়েছিল। সাধারণ ভাবে এই ধরনের চুক্তির জন্য বিবেচিত হতে গেলে পর্যটন ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট সংস্থার অন্তত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। অথচ সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস রেলকে জানিয়েছিল, তারা ২০০৭ সাল থেকে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তার পরেও তারা কী ভাবে বরাত পেল, সেটা প্রশ্ন। তা ছাড়া, ২০০৭ সাল থেকেও তারা পর্যটন ব্যবসা করেছে কি না, বা কী মাপের করেছে, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। তৎকালীন রেলকর্তারা এ সব খতিয়ে দেখেছিলেন কি না, সেটা তদন্ত করে দেখা হবে। এমনকী, সামগ্রিক চুক্তিপত্রে রেলমন্ত্রীর দফতরের কোনও লিখিত বক্তব্য আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিবিআই। সন্দেহের তালিকায় মমতার ঘনিষ্ঠ তৎকালীন এক রেল অফিসারের নামও রয়েছে।
সিবিআই তদন্তের ছায়া যখন তৃণমূল নেত্রীর উপরে পড়তে চলেছে, তখন দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা তথা প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়ের বক্তব্যের ইঙ্গিত যথেষ্ট অর্থবহ বলে মনে করছেন অনেকেই। সোমবার মুকুল বলেছিলেন, “একটি সংস্থার কাছ থেকে আর একটি সংস্থা বরাত পেয়েছে। তাতে কী এমন হয়েছে!” সিবিআই যে কার্যত সারদার স্বার্থ দেখার জন্যই তদন্তের নামে এ সব করছে, তেমন কথাও বলেছিলেন তিনি। অথচ, মঙ্গলবার সেই মুকুলই বলেন, “যদি কিছু হয়ে থাকে তার তদন্ত হতে পারে। সিএজি আছে, রেলওয়ে অডিট আছে।”
মমতা রেলমন্ত্রিত্ব ছেড়ে রাজ্যে চলে আসার পরে মুকুল প্রথম কিছু দিন রেল দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তার পর তৃণমূলেরই দীনেশ ত্রিবেদী রেলের পূর্ণমন্ত্রী হন। বাজেটে রেলভাড়া বাড়ানোর কথা ঘোষণা করে মমতার রোষানলে তাঁর পদ যায়। রেলেই পূর্ণমন্ত্রী হয়ে ফেরেন মুকুল। তৃণমূল ইউপিএ ছেড়ে আসা পর্যন্ত রেলমন্ত্রী ছিলেন মুকুলবাবুই।
তিনি মঙ্গলবার বলেন, “এই বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। এই চুক্তি যখন হয়, তার পরে দীনেশ ও আমি মন্ত্রী হই।” অনেকেই বলছেন, তাঁর পূর্বসূরি এবং দলনেত্রী মমতার আমলের বাজেটে ঘোষিত একটি প্রকল্পের গতিপ্রকৃতি মুকুলবাবু জানবেন না, এই যুক্তি মানা কঠিন। তাই, প্রশ্ন উঠেছে, মুকুল কি জেনেবুঝেই নিজেকে বিষয়টি থেকে দূরে রাখতে চাইছেন? তিনি কি বোঝাতে চাইছেন, ‘অন্যের’ বোঝা তিনি বইবেন না?
বস্তুত সেই কথাই বলছেন বিরোধীরা। তাঁদের দাবি, সিবিআইয়ের ফাঁস চেপে বসছে দেখে মুকুলের গলায় অন্য সুর শোনা যাচ্ছে। সারদা-কাণ্ডের তদন্ত তৃণমূলের মধ্যে অন্তর্কলহ লাগিয়ে দিচ্ছে। তদন্তে যখন যাঁর নাম উঠে আসছে, তাঁর থেকে দূরত্ব তৈরি করতে চাইছেন বাকিরা। এমনকী, সেই নাম স্বয়ং মমতার হলেও!
সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কটাক্ষ, “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা! বিপদে পড়ে মুকুল এখন এই নীতি নিয়েছেন!” তাঁর বক্তব্য, “কোনও অভিযোগ উঠলেই তৃণমূল বলে ষড়যন্ত্র, সাজানো বা ছোট্ট ঘটনা। কখনও বলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আর মুকুল বরাবরই হিজ মাস্টার্স ভয়েস। এই প্রথম ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে না-দিয়ে তিনি বললেন, আমার সময়ে হয়নি। তার মানে বিপদ বুঝে উনি হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছেন!” প্রাক্তন রেল প্রতিমন্ত্রী তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মন্তব্য, “দিদির নাম এসেছে দেখে ভাই এখন পালাচ্ছে! তৃণমূলে এখন অদ্ভুত খেলা চলছে। মদন মিত্রের নাম জড়াচ্ছে তো সবাই তাকে ফেলে পালাচ্ছে। দিদিও তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন না। আবার দিদির নাম উঠেছে বলে ভাই মুকুল পালাচ্ছে!” অধীরবাবুর দাবি, তৃণমূলে এ ভাবেই অভ্যন্তরীণ বিরোধ চড়ছে। প্রায় একই সুরে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও বলেছেন, “ওদের মধ্যে এখন লেগে গিয়েছে! ওই চুক্তির সময় মুকুল রেলমন্ত্রী ছিলেন না ঠিকই। কিন্তু তাঁর কথায় মনে হচ্ছে, তিনি তাঁর নেত্রীর দায় ঘাড়ে নিতে চাইছেন না।”
মমতার পরেই যিনি রেলমন্ত্রী ছিলেন, সেই দীনেশ ত্রিবেদী অবশ্য গোটা বিতর্কে মুখ খুলতে চাননি। ঘটনাচক্রে, যিনি এ দিনই সংসদের রেলওয়ে স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন। তবে মুকুলবাবুর মন্তব্যে যে মোচড় আছে, তা টের পাচ্ছেন তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারাও। তাঁদের এক জনের কথায়, “আইআরসিটিসি-র কাজে রেল মন্ত্রক সচরাচর মাথা গলায় না। আর দিদির সততা নিয়েও প্রশ্ন নেই। কিন্তু বাকি সকলকে এড়িয়ে সারদার ওই সংস্থাকে বরাত পাইয়ে দিতে কোনও প্রভাব কাজ করেছিল কি না, সেটা দেখা যেতে পারে। হতে পারে, মুকুলবাবু হয়তো সে কথাই বলতে চেয়েছেন।”
সাধারণ ভাবে অবশ্য সিবিআই তদন্তের বিরুদ্ধে এ দিনও যথেষ্ট চড়া সুর ছিল মুকুলবাবুর। তিনি আগের মতোই বলেন, “সিবিআই যে একটা স্বশাসিত সংস্থা নয়, তা ওই সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল আদালতে হলফনামা দিয়ে বলেছিলেন। আগে আমরা সিবিআই-কে বলতাম কংগ্রেস ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। সিবিআই পাল্টায়নি। সিবিআই এখনও চলে কারও অঙ্গুলি হেলনেই।” মুকুলবাবুর বক্তব্যের প্রতিবাদ করে রাহুল সিংহ অবশ্য বলেন, “বিজেপি কোনও ভাবেই সিবিআই-কে প্রভাবিত করছে না। এর পরেও যদি কারও কাছে কোনও তথ্য-প্রমাণ থাকে তা হলে তিনি শীর্ষ আদালতে বিজেপি-র নামে নালিশ করতে পারেন। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই সারদা-কাণ্ডের তদন্ত করছে সিবিআই।”
রেল-সারদা যোগ নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করলেও এ নিয়ে আলাদা করে কোনও মামলা অবশ্য দায়ের করছে না সিবিআই। সংস্থার মুখপাত্র আজ বলেন, এ নিয়ে নতুন করে কোনও প্রাথমিক তদন্তও শুরু হচ্ছে না। যে তদন্ত চলছে, তার অধীনেই এই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
সিবিআইয়ের এক তদন্তকারী অফিসারের ব্যাখ্যা, “সারদা কেলেঙ্কারিতে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের যোগসূত্র মিলেছে। সারদার সঙ্গে রেলের ব্যবসার পিছনেও সেই একই রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে বলে আমাদের সন্দেহ। সেই কারণেই এই বিষয়টি আলাদা করে দেখার কোনও প্রয়োজন নেই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy