শঙ্খ ঘোষ। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
সকালে ফোন এসেছিল আবিরের। প্রথম কয়েকটা মিসড কল হয়ে যায়। তখন ফোন বাড়ির আর একটা নম্বরে। ওর গলায় খানিক অচেনা স্বর। জেঠু কেমন স্থির হয়ে গেছে সাত্যকিদা।
খুব বেশি না হলেও আবিরের জেঠুকে নিয়ে মাঝে মাঝে কথা হত গত কয়েক মাস। করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর দু’দিন কথা হল। তবু সকালবেলা হঠাৎ স্থির হয়ে যাওয়ার সংবাদ। শহরের ভেতর সাত-আট কিলোমিটার পথ। বলা মাত্রই পৌঁছনো যায় না। তখন আবির ভিডিয়ো কল করল। ভিডিয়ো কলে দেখাল হাত, যেখানে কোনও নড়াচড়া নেই। ওকে বললাম, পেটের কাছটা দেখাতে। ও শায়িত কবির পেটের জায়গাটুকু আলগা করে দেখাল। দেখলাম, শ্বাসের যে স্বাভাবিক নামা-ওঠা পেটে অনুভূত হয়, সেটি নেই। ওকে বললাম, মুখ দেখাও, চোখ দেখাও এ বার। মোবাইলের ক্যামেরা ঘনিষ্ঠ হল মুখের কাছটায়।
‘মুখের কথা একলা হয়ে/… রইল পড়ে গলির কোণে/ ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু/ ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে’। দেখলাম ক্লান্ত আধবোজা দু’টি চোখ, স্থির গাল এবং মুখের উপর চেপে বসা তখনও অক্সিজেনের মুখোশ। আবিরকে বললাম, একটু অপেক্ষা করো, আসছি।
গাড়িতে মিনিট পনেরোর বেশি নয়। তবু সকালের অফিসমুখী শহরে সব মিলিয়ে আধ ঘণ্টা তো বটেই। উল্টোডাঙার হাডকো মোড়ের ওই জায়গাটুকু দিয়ে যখন যেখানে গিয়েছি ক্ষণিক মনে হয়েছে শঙ্খ ঘোষ এখানে থাকেন। একদা গৌরকিশোর ঘোষের কাছেও এখানেই আসতাম। সেই গলি, গলির মুখ ছাড়িয়ে ঢুকে গেলে পথের বাঁকে শহর যেন আধ মিনিটেই আড়ালে চলে যায়। হাডকোর ওই হাউজিং এখনও খানিকটা নিভৃতাবাস।
তখন সবেমাত্র এসে পৌঁছেছেন পরিবারের ক’জন। যাঁরা ও বাড়িতে সঙ্গে থাকছিলেন তাঁদের বাদ দিয়ে গুটি গুটি কয়েকটি উৎকণ্ঠার মুখ এসেছেন নীচের তলায় সিঁড়ির কাছাকাছি। পাতা পড়ার শব্দও কি শোনা যাচ্ছিল কলকাতায়! অথবা ফিসফিসিয়ে বলা বাঙালির আবহমান শোকের দু’একটি সংলাপ! পরিচিত গৃহকোণটির এ ঘর ও ঘর পার করে আবির-ই আমাকে নিয়ে গেল ভেতরে, একেবারে ভেতরের ঘরটিতে, যে ঘরে মাথার দিক ওঠানো বেডে মুখ একপাশে সামান্য এলিয়ে শায়িত তিনি।
প্রাণ শরীর ছেড়ে চলে গেলে সে শরীরে এমনকি সে ঘরেও মৃত্যুর ছাপ চিকিৎসকের চোখে ধরা পড়ে। বাতাস যেন হাঁটু মুড়ে বসে থাকে বিছানার পাশে। তবু চিকিৎসককে কবির কব্জির চাদর সরিয়ে নাড়ির থেমে যাওয়া বুঝতে হয়। বুঝতে হয় মৃত্যুর আর কয়েকটি খুঁটিনাটি।
পরিজনরা বুঝতে পারছিলেন। আমি আমার জানাটুকু তবু বললাম। তার পর হাত ধুয়ে নেমে এলাম নীচে।
সেখানে তখন হাজির আরও কয়েক জন। বিষাদ ছড়াচ্ছে মুখে মুখে। কথা ছড়াচ্ছে গলির ও পাশে। আবার একটি দীর্ঘ শোকযাত্রার মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে বাঙালি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy