ভারতে নিষিদ্ধ হয় ১৯৮৮ সালে। আনন্দবাজার আর্কাইভ।
নিউ ইয়র্কে আক্রান্ত সলমন রুশদি। প্রাণে বেঁচেছেন। ভেন্টিলেটর থেকে বার করা হয়েছে তাঁকে। অল্পস্বল্প কথাও বলছেন। দশকের পর দশক ধরে তিনি ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে রয়েছেন। তবে এ বার তাঁর শরীরে ছুরির কোপ নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে এক দাবি। দাবি— ‘নতুন ভারত’ সিদ্ধান্ত বদলাক! ৩৪ বছর আগে তাঁর লেখা উপন্যাসে যে নিষেধাজ্ঞার ‘কোপ’ পড়েছিল, তা এ বার তুলে দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
এই দাবি প্রথম তুলেছেন চলচ্চিত্র পরিচালক তথা অভিনেত্রী অপর্ণা সেন। রুশদির উপরে আক্রমণের নিন্দা করে টুইট করার পাশাপাশি তিনি লেখেন, ‘কংগ্রেস সরকার তাদের তোষণনীতির জন্য যে ভাবে অসাংবিধানিক কায়দায় দ্য স্যাটানিক ভার্সেস-কে নিষিদ্ধ করেছিল, আমি তার তীব্র নিন্দা করি। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আর্জি জানাব, স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আমাদের সংবিধানের সম্মানরক্ষার্থে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হোক।’
I condemn the uncostitutional banning of The Satanic Verses by the Congress govt with its appeasement policies. I urge the govt in power to lift the ban and honour our Constitution on the the 75th anniversary of our Independence.
— Aparna Sen (@senaparna) August 14, 2022
এই দাবি কি শুধু অপর্ণার? এই শহরে আর কোনও বিশিষ্ট কি এমন দাবি তুলছেন? প্রশ্ন নিয়ে খোঁজ শুরু করেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। দেখা গেল, অনেকেই চান, উঠে যাক নিষেধাজ্ঞা। পদক্ষেপ করুন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সে দাবিতে শামিল তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ বিশিষ্টদের পাশাপাশিই গেরুয়া শিবিরের খ্যাতনামীরাও।
যেমন বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তের কথায়, ‘‘যে সময়ে এই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল, তখন বিজেপি তার বিরোধিতা করেছিল। দলের নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী প্রতিবাদ জানিয়ে একটি লেখাও লিখেছিলেন। আমার মনে হয়, এখনও পর্যন্ত যত বই নিষিদ্ধ হয়েছে, তার সবগুলিকেই নতুন করে মূল্যায়ন করা হোক না! কোনও ক্ষতি তো নেই।’’ প্রাক্তন সাংবাদিক স্বপনের আরও বক্তব্য, ‘‘আমি তো মনে করি, অশ্লীলতা ছাড়া কোনও বই কোন রাজনৈতিক অবস্থান থেকে লেখা বা তাতে কী যুক্তি রয়েছে, সেই বিচার করে নিষিদ্ধ করা অনুচিত। পাঠক ঠিক করবেন সে বই তিনি পড়বেন বা কিনবেন কি না।’’ তবে অপর্ণা তাঁর দাবিতে কতটা সমর্থন পাবেন, তা নিয়ে নিশ্চিত নন স্বপন। তিনি বলেন, ‘‘ওঁর মতের সঙ্গে যাঁরা একমত, তাঁরা কতজন এই নিষেধাজ্ঞা তোলার পক্ষে অভিমত দেবেন আমি জানি না।’’
রুশদি বইটি লিখেছিলেন ১৯৮৮ সালে। সে বছর ২৬ সেপ্টেম্বর বইটি ইংল্যান্ডে প্রকাশিত হয়। তার কিছুদিনের মধ্যেই তৈরি হয় বিতর্ক। উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট ছিল ইসলামপূর্ব আরব সমাজ। সেখানে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তককে নিয়ে যে বক্তব্য ছিল, তা মেনে নিতে পারেননি অনেকে। বিক্ষোভের জেরে বিশ্বের বহু দেশেই নিষিদ্ধ হয় ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’। তবে শুরুটা হয় ভারতে। মূলত কংগ্রেস সাংসদ সৈয়দ সাহাবুদ্দিন এবং খুরশিদ আলম খান (সলমন খুরশিদের পিতা)-এর ‘চাপে’ পড়েই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী ভারতে ওই বই আমদানির উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কেউ বিদেশ থেকে যাতে ওই বই নিয়ে না আসেন, তার নির্দেশও দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, রুশদির ভারতে আসার উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। সেটা ছিল ১৯৮৮ সালের অক্টোবর। তার ১১ বছর পরে ১৯৯৯ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় রুশদির উপর ভারতে আসার নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। কিন্তু রুশদি ভারতে আসতে পারলেও তাঁর বইটির উপরে নিষেধাজ্ঞা এখনও রয়ে গিয়েছে। সেটা কি ঠিক?
নাট্যব্যক্তিত্ব দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আমি যে কোনও শিল্পের স্বাধীনতার পক্ষে। কোনও নিষেধাজ্ঞাই ঠিক নয়। পাঠক ঠিক করবেন, গ্রহণ করবেন কি না। বই, ছবি, নাটক, সিনেমার উপর রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকা উচিত নয়। তাই আমি চাই, উঠে যাক সব নিষেধাজ্ঞা।’’
একই সুর চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্নর গলাতেও। ভারতে রুশদির বই নিষিদ্ধ হওয়ার কিছু দিন পরেই বইটির জন্য ধর্মদ্রোহের অভিযোগে উত্তাল হয় বিভিন্ন দেশের কট্টরপন্থী ইসলামি সংগঠন। এমনকি, রুশদির বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানাও জারি করা হয়। আয়াতোল্লাহ খোমাইনি রুশদির মাথার দাম রাখেন ৩০ লক্ষ ডলার।
সেই প্রসঙ্গ টেনে শুভাপ্রসন্ন বলেন, বলেন, ‘‘ফতোয়া দেয় অন্ধ লোকেরা। উচিত-অনুচিত বোধ থাকলে এ জিনিস হতে পারত? এত বছর পরে রুশদিকে আক্রমণের মানে এখনও সেই রাগ রয়ে গিয়েছে। এঁদের সঙ্গে তো আর সাধারণ মানুষ যোগাযোগ করে কিছু করতে পারবে না।’’ নিষেধাজ্ঞা তোলার বিষয়ে প্রবীণ চিত্রশিল্পী বলেন, ‘‘ভারতের যে ধর্ম, নীতি এবং দর্শন, তাতে কোনও বইকেই নিষিদ্ধ করা যায় না। আমি অনুরোধ করব, ভারত সরকার যেন বিবেচনা করে দেখে।’’
একই ভাবনা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমেরও। তিনি বলেন, ‘‘একটা সরকার এক রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পরের সরকার এসে তা বদলাতেই পারে।’’ একইসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘কোনও গান, সিনেমা, কবিতা, নাটক বয়কট করার দাবি উঠলে কিছু এসে যায় না। যাঁরা পড়ার তাঁরা ঠিকই পড়েন। যাঁরা দেখার দেখেনও।’’ তিনি কি চান ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সাস’ থেকে এখন নিষেধাজ্ঞা উঠুক? সরাসরি জবাব এড়িয়ে সেলিম বলেন, ‘‘কোনও নিষেধাজ্ঞাই মানুষকে আটকে রাখতে পারে না। বরং তাতে আরও আগ্রহ তৈরি হয়।’’
তবে কেন্দ্রের কাছে এ নিয়ে দরবার করার পক্ষে কবি জয় গোস্বামী। তাঁর কথায়, ‘‘আমি যে কোনও বইয়ের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে। বই মানুষ পড়ে সিদ্ধান্ত নেবেন বইটি খারাপ না ভাল। আগে থেকে রাষ্ট্রশক্তির নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়ার মানে হয় না। এটা রাষ্ট্রের পক্ষে অনধিকার চর্চা বলে আমি মনে করি।’’
রুশদির উপরে আক্রমণের প্রসঙ্গে জয় টেনে এনেছেন তসলিমা নাসরিনের ঘটনাও। তিনি বলেছেন, ‘‘রুশদির বিরুদ্ধে আয়াতোল্লাহ খোমাইনি যখন মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া জারি করেন, তখন এই হামলাকারীর জন্ম হয়নি। তার বয়স মাত্র ২৪। ভারত সরকারের কাছে আমার বিশেষ ভাবে অনুরোধ যে, একজন বাঙালি লেখক প্রাণদণ্ডাজ্ঞা মাথায় নিয়ে দিল্লিতে বসবাস করছেন। তাঁর জীবন যে কোনও মুহূর্তে বিপন্ন হতে পারে। রুশদির উপরে হামলা তারই সঙ্কেত দিচ্ছে। তসলিমা নাসরিনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হোক। তাঁকে যাতে কোনও ভাবেই আমাদের হারাতে না হয়, সে ব্যাপারে সরকার যেন সদাজাগ্রত দৃষ্টি রাখে।’’
রুশদির বইয়ের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তোলার ব্যাপারে ভারত সরকারের কাছে দরবার করার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া যায়? জয় বলেন, ‘‘আমি সংগঠক নই। সাহিত্যসমাজে যাঁরা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি রয়েছেন যেমন, কবি সুবোধ সরকার, কবি শ্রীজাত, ব্রাত্য বসুর কথা অন্য সাহিত্যিকরা মেনে চলেন। তাঁরা যদি সম্মিলিত ভাবে কোনও আবেদনপত্র তৈরি করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠান এবং আমার স্বাক্ষর চাওয়া হয়, আমি সেখানে স্বাক্ষর দেব।’’
যে প্রসঙ্গে সুবোধ বলছেন, ‘‘বাজপেয়ি সরকার রুশদিকে বলেছিল আপনি ভারতে আসতে পারেন। যদিও আমরা জানি জয়পুর লিটারারি ফেস্টিভ্যালে তাঁর আসা আটকানো হয়। মুম্বই, কলকাতাতেও সম্ভব হয়নি। এখন যদি ভারত সরকারকে সবাই মিলে, সব দলের হয়ে অনুরোধ করা হয় নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে, আমি আছি। ৩৮২ বছর বাদে যদি ভ্যাটিক্যানের যাজকেরা গ্যালিলিওকে মেনে নিতে পারে, স্বীকার করে নিতে পারে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, তা হলে এবার সলমন রুশদির বইটিও আমাদের চারদিকে ঘুরুক।’’
‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ থেকে নিষেধাজ্ঞা তোলার বিষয়ে সুবোধের বক্তব্য, ‘‘যে বই নিষিদ্ধ হয়, সে বই দশগুণ শক্তি নিয়ে পাঠকের বালিশের নীচে শুয়ে থাকে। ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ ভারতে ঢুকতে পারবে না— এই ছিল নিষেধাজ্ঞা। নিউ ইয়র্কে যে ছেলেটি রুশদিকে খুন করতে গিয়েছিল, তার জন্মের কুড়ি বছর আগে ইরান থেকে ফতোয়া জারি হয়েছিল। বই ছাপানোর আগে রুশদি ফোন করে আয়াতোল্লা খোমেইনিকে শুনিয়েছিলেন সেই বিতর্কিত অংশ। খোমেইনি আপত্তি করেননি। তবু ফতোয়া জারি হয়েছিল। এত বছর বাদে সেই ফতোয়ার অনেকটাই কার্যকরী হল। অনেকে আনন্দ করছে। অনেকে চোখের জল মুছছে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy