Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
CPM

CPM: সিপিএম অফিসে তেরঙা তুলতে ডাক তৃণমূল বিধায়ককে, নিচুতলার কি আলিমুদ্দিনে অনাস্থা?

পাণ্ডবেশ্বর বিধানসভা এলাকায় সিপিএম দফতরে পতাকা তুলতে গিয়েছিলেন তৃণমূল বিধায়ক। দলের লোকেরাই এ নিয়ে নিন্দায় সরব।

অস্বস্তি ঢাকতে অন্য যুক্তি সেলিমের।

অস্বস্তি ঢাকতে অন্য যুক্তি সেলিমের। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

পিনাকপাণি ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০২২ ১৬:৩২
Share: Save:

এটা কি সম্প্রীতির ছবি? নাকি সিপিএমের অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়ের ইঙ্গিত? একদা ‘লালদুর্গ’ বলে পরিচিত বর্ধমানের (অধুনা পশ্চিম বর্ধমানের) পাণ্ডবেশ্বরে সিপিএমের পার্টি অফিসে জাতীয় পতাকা তুলতে তৃণমূল বিধায়ককে ডাকার মতো ‘ঐতিহাসিক’ ঘটনা আসলে কিসের ইঙ্গিত?

এর অর্থ কি নেতাদের প্রতি নিচুতলার কর্মীদের অনাস্থা? নাকি দলত্যাগের দিকে এক পা এগিয়ে যাওয়া? এই ঘটনা কি আসলে একদা বাংলার শাসক সিপিএমের বিপন্ন ভবিষ্যতের ছবি? যা দেখে দলের অন্দরেই বিবিধ প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

সিপিএমের পার্টি অফিসে তৃণমূল বিধায়ককে আমন্ত্রণ করে এনে স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকা তোলানোর সেই ছবি ‘অস্বস্তি’তে ফেলেছে সিপিএমকে। কেউ কেউ একে ‘রাজনৈতিক সম্প্রীতি’-র ছবি বলে একটা আলগা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ‘রাজনৈতিক সম্প্রীতি’-র সীমা কি এতখানি হতে পারে? ত্রিপুরায় কি শাসক বিজেপির বিধায়ককে ডেকে এনে তাদের অফিসে পতাকা তোলাবে বিরোধী সিপিএম বা তৃণমূল?

সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘সিপিএম কর্মীরা ওই তৃণমূল বিধায়ককে ডাকেননি। তৃণমূলের বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নিজে থেকেই গিয়ে পতাকা তুলে দিয়েছেন!’’ কিন্তু রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ থেকে দলের বর্তমান প্রজন্মের নেতা সায়নদীপ মিত্র এর মধ্যে ওই এলাকার কমরেডদের ‘বিচ্যুতি’ দেখছেন।

নরেন্দ্রনাথ আবার সে দাবি উড়িয়ে সম্প্রীতির কথাই বলছেন।

স্থানীয় সূত্রের খবর, সোমবার পাণ্ডবেশ্বরের নবগ্রাম শাখার পার্টি অফিস ‘কিষাণ ভবন’-এর সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন শাসক দলের বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ। তখন সিপিএম কর্মীরা তাঁকে দলীয় দফতর চত্বরে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অনুরোধ করেন। এক কথায় রাজি হন স্থানীয় বিধায়ক। জাতীয় পতাকা তোলার পর ছোট্ট বক্তৃতাও করেন। যেখানে তিনি বলেন, ‘‘আজ স্বাধীনতা দিবস। আজ কোনও রাজনৈতিক ভেদাভেদ নেই। আমরা সকলে ভারতবাসী। এটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিক্ষা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এক সময় চুলের মুঠি ধরে মহাকরণ থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল। আবার সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর বাম নেতাদের ফিশ ফ্রাই খাইয়ে আপ্যায়িত করেছিলেন।’’

এর মধ্যে প্রাথমিক ভাবে অবশ্য জেলা সিপিএম খুব একটা ‘অন্যায়’ দেখেনি। নবগ্রাম শাখার সম্পাদক নেতা হাবিবুল শেখের যুক্তি ছিল, ‘‘আজ একটি আলাদা দিন। বিধায়ক জাতীয় পতাকা তুলেছেন। সে জন্য আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আজকের দিনে কোনও রাজনীতি নয়।’’ সেই সুরেই পশ্চিম বর্ধমান জেলার সম্পাদক গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘এটা গ্রামের রাজনীতি। সকলে মিলেমিশে থাকেন। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করাটা কোনও ভুল নয়। এটা অপরাধ নয়। উনি সকলের বিধায়ক।’’

হাবিবুল, গৌরাঙ্গরা যা-ই বলুন, ক্রুদ্ধ রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ। তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘এটা একেবারেই অন্যায় কাজ। যে নেতারা করেছেন, তাঁদের নেতৃত্বে থাকারই অধিকার নেই!’’ নিজেদের নেতাকে না ডেকে তৃণমূল বিধায়ককে ডাকা কেন? দলীয় নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধার খামতি? সুশান্তের জবাব, ‘‘এটা ওখানকার নেতাদের বালখিল্যতা। তৃণমূলের শ্রেণিগত অবস্থান সম্পর্কে কোনও ধারণা না থাকার জন্যই ওঁরা এটা করেছেন। এঁরা সিপিএমে থাকার অযোগ্য। দলের সদস্য থাকার যোগ্যতাও নেই এঁদের!’’

দলের যুবশাখা ডিওয়াইএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘আমি গোটা ঘটনাটা জানি না। তবে এরকম হওয়ার কথা নয়।’’ যুবশাখার প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথা সিপিএম রাজ্য কমিটির সদস্য সায়নদীপ বলেন, ‘‘কোনও সামাজিক সংস্থার অনুষ্ঠানে আমাদের দলের লোকেরা যুক্ত থাকলে সেটা অন্য বিষয়। কিন্তু স্বাধীনতা দিবসের পতাকা তো আমাদের পার্টির লোকেরাই তুলবেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের দলের আত্মত্যাগের অভাব আছে নাকি! এটা একেবারেই ঠিক হয়নি।’’

এর অর্থ কি নিচুতলার কর্মীদের নেতাদের সম্পর্কে শ্রদ্ধা এবং তাঁদের উপর আস্থা কমছে? উল্টে ভক্তি বাড়ছে শাসক তৃণমূলের প্রতি? সায়নদীপ অবশ্য সেটা মানতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘তৃণমূলের প্রতি তৃণমূলের কর্মীদেরই শ্রদ্ধা কমে যাচ্ছে। নেতাদের নিয়ে লজ্জা পাচ্ছেন কর্মীরা। সেখানে আমাদের পার্টির লোকেদের কী করে তৃণমূলের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ে সেটা আমি জানি না!’’

তবে ‘অস্বস্তি’ যে একটা তৈরি হয়েছে, তা স্পষ্ট দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়ায়। গোটা ঘটনা শোনার পরে তিনি কোনও মন্তব্য করতেই রাজি হননি। শুধু বলেন, ‘‘এ বিষয়ে যা বলার রাজ্য সম্পাদক বলবেন।’’ আর রাজ্য সম্পাদক সেলিমের দাবি, তাঁদের দলের লোকেরা তৃণমূল বিধায়ককে ডাকেনইনি। নরেন্দ্রনাথ যেচে এসেছেন। সেলিম বলেন, ‘‘উনি ওখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। আর সিপিএমের লোকেরা ঝান্ডা তুলবেন বলে বসে ছিলেন ওখানে। তৃণমূল তো এই রকম করে! আমাদের শেষের দিকে বা এখনও করে। রাস্তা বা সেতু নিজের থেকে উদ্বোধন করে দেয়। এটাও সে রকম। নিজের বাজার ধরে রাখার জন্যই পতাকা তুলে দিয়েছে।’’

বস্তুত, সেলিম মানতে নারাজ যে, সিপিএম কর্মীরাই স্থানীয় বিধায়ককে আমন্ত্রণ করেছিলেন। তাঁর দাবি, ‘‘সংবাদমাধ্যমের একাংশ ভুল খবর পরিবেশন করছে। আমাদের লোকেরা বসে ছিলেন। বিধায়ক গাড়ি থামিয়ে পতাকা তোলেন। পরে বলেন, ‘আমি তোদের পতাকা তুলে দিলাম।’ আগে মনোভাব ছিল, কেউ পতাকা তুলবে না। আর এখন হয়েছে তুলতে হলে শুধু আমিই তুলব।’’

সেলিমের দাবির প্রেক্ষিতে তৃণমূলের বিধায়ক নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। তিনি বলেন, ‘‘আমি কেন জোর করে পতাকা তুলতে যাব? আমাদের এখানে সবাই মিলেমিশে থাকি। রাজনৈতিক হানাহানি নেই। ওঁরা ডেকেছেন। আমি গিয়েছি। এর বাইরে কিছু নয়। যাঁরা এখানে সিপিএম করেন, তাঁরা আমার ছোট ভাই। পতাকা তোলা হয়নি। তাই তাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন। আমাকে ডাকলেন ওঁরা। আমি গিয়ে পতাকা তুললাম।’’

অন্য বিষয়গুলি:

CPM TMC Md Selim
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy