Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

হকারদের তাণ্ডবে মৃত আরপিএফ কর্মী

মাস চারেক ধরে ধিকিধিকি আগুন জ্বলছিল। কিন্তু তা মেটাতে তেমন ভাবে উদ্যোগী হননি কেউই। সোমবার দুপুরে সেই আগুনেই তুলকালাম ঘটে গেল মালদহ স্টেশন চত্বরে। লাইসেন্সহীন হকারদের তাণ্ডবে ইটের আঘাতে আরপিএফের এক কনস্টেবলের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর নাম সমরেশ সামন্ত (৩৫)। গুরুতর আহত হয়েছেন ঝাটন দাস নামে এক হকারও। প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে উত্তাল হয়ে থাকে গোটা এলাকা।

আরপিএফ কনস্টেবল আর কে শাহকে ঘিরে ধরে মার হকারদের। (ডান দিকে) পড়ে রয়েছে নিহত সমরেশ সামন্তের দেহ। — নিজস্ব চিত্র

আরপিএফ কনস্টেবল আর কে শাহকে ঘিরে ধরে মার হকারদের। (ডান দিকে) পড়ে রয়েছে নিহত সমরেশ সামন্তের দেহ। — নিজস্ব চিত্র

অভিজিৎ সাহা
মালদহ শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৫ ০৪:০০
Share: Save:

মাস চারেক ধরে ধিকিধিকি আগুন জ্বলছিল। কিন্তু তা মেটাতে তেমন ভাবে উদ্যোগী হননি কেউই। সোমবার দুপুরে সেই আগুনেই তুলকালাম ঘটে গেল মালদহ স্টেশন চত্বরে। লাইসেন্সহীন হকারদের তাণ্ডবে ইটের আঘাতে আরপিএফের এক কনস্টেবলের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর নাম সমরেশ সামন্ত (৩৫)। গুরুতর আহত হয়েছেন ঝাটন দাস নামে এক হকারও। প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে উত্তাল হয়ে থাকে গোটা এলাকা। আরপিএফ শূন্যে ১৩ রাউন্ড গুলি ছুড়েছে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি কোনও মতে নিয়ন্ত্রণে আনে।
লাইসেন্সহীন হকারদের জানুয়ারি থেকেই স্টেশন চত্বর থেকে উচ্ছেদ করে দেয় মালদহের আরপিএফ। প্রায় শ’চারেক হকার কর্মহীন হয়ে পড়েন। তখন থেকেই তাঁরা বারবার রেল কর্তৃপক্ষের কাছে ফের স্টেশনে ব্যবসা করতে দেওয়ার জন্য দরবার করতে থাকেন। রাজনৈতিক দলগুলিও সব কথা জানত। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। এ দিন সকাল ৯টা নাগাদ এক রকম মরিয়া হয়েই মালদহ টাউন স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে রুটি আর সব্জি বিক্রি করতে বসে যান লাইসেন্সহীন হকার ঝাটনবাবু। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তেড়ে আসেন আরপিএফ জওয়ানেরা। অভিযোগ, তাঁরা তখন বেধড়ক মারধর করেন ঝাটনবাবুকে। তাঁর মাথা ফেটে যায়। ঝাটনবাবুর আত্মীয় পরিজনেরা তাঁকে মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সে খবর ছড়াতেই উত্তেজনা বাড়তে থাকে। লাইসেন্সহীন প্রায় শ’খানেক হকার জড়ো হন স্টেশনে আরপিএফ ব্যারাকের কাছে। তাঁরা আরপিএফের কাছে অভিযোগ জানাতে যান। ভারতীয় মজদুর সংঘের মালদহ হকার ইউনিয়নের সম্পাদক সুবল দাস বলেন, ‘‘আরপিএফ আমাদের অভিযোগ নিতে চায়নি। এমনকী, তারা দাবি করে, ঝাটনকে তারা মারধরও করেনি।’’

এর পরেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন এই হকারেরা। বেলা ১২টা নাগাদ তাঁরা স্টেশন রোড অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। তাতে সামিল হন মহিলারাও। অবরোধ আধ ঘণ্টার মতো চলার পরে উত্তেজিত হকারদের একাংশ আরপিএফ ব্যারাকের দিকে ইট পাথর ও কাচের বোতল ছুড়তে থাকেন।

আরপিএফ কনস্টেবল সমরেশবাবু তখন হইচই শুনে ব্যারাকে নিজের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আচমকা একটি ইটের খণ্ড এসে পড়ে তাঁর মাথায়। মাথা ফেটে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। বেলা তখন পৌনে একটা।

আরপিএফ জওয়ানেরা তখনই আগ্নেয়াস্ত্র ও লাঠি নিয়ে হকারদের দিকে তেড়ে যান। হকাররাও পাল্টা ইট বৃষ্টি শুরু করেন। আরপিএফ জওয়ানেরা শূন্যে গুলি চালান। ব্যারাক সংলগ্ন এলাকায় কংগ্রেসের হকার ইউনিয়নের একটি ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র তাঁরা ভেঙেচুরে দেন বলেও হকারদের অভিযোগ। সেই সময়ে আরপিএফের এক কনস্টেবল আর কে শাহকে ঘিরে ধরে এলোপাথাড়ি মারধর শুরু করেন হকারদের কয়েক জন। তিনি কোনও মতে দৌড়ে পালান। ইতিমধ্যে আরপিএফের সঙ্গে যোগ দেয় পুলিশের একটি বড় বাহিনী। তা দেখেই বেলা আড়াইটে নাগাদ রণে ভঙ্গ দেন হকারেরা। সারা এলাকা তখন থমথমে।

কিন্তু সকাল থেকে একটু একটু করে ঘটনার আঁচ বাড়তে থাকলেও প্রশাসন তা মেটাতে উদ্যোগী হয়নি কেন? পুলিশের এক বড় কর্তা জানান, এ দিন ঘটনা এত বড় আকার নেবে তা আগে থেকে বোঝা যায়নি।

কিন্তু হকারদের সমস্যা মেটানোর চেষ্টাই বা করা হয়নি কেন? পূর্ব রেলের মালদহের ডিআরএম রাজেশ আরগাল জানান, লাইসেন্সহীন হকারদের স্টেশনে বসতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত রেলবোর্ডের। তিনি বলেন, ‘‘ওঁরা আমাদের অনেক বার স্মারকলিপি দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের কিছু করার নেই।’’

লাইসেন্সহীন হকারদের এই আন্দোলনে অনেক সময় প্রথম সারিতে দেখা গিয়েছে জেলা তৃণমূলের নেতা তথা ইংরেজবাজার পুরসভার বিদায়ী ভাইস চেয়ারম্যান দুলাল সরকারের ঘনিষ্ঠদের। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতেন কংগ্রেসের জেলা সাধারণ সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ তিওয়ারিও। তাঁদের কেউই অবশ্য এ দিন ঘটনাস্থলে ছিলেন না। দুলালবাবুর বক্তব্য, ‘‘রেল কর্তৃপক্ষ আরও সহনশীলতা দেখাতে পারতেন। তাঁদের জন্যই এমন কাণ্ড ঘটল।’’ তবে তাঁর দাবি, এ দিন যে এই হকাররা এমন আন্দোলনে নামবেন, তা তিনি জানতেন না।

নরেন্দ্রনাথবাবুও একই সুরে বলেন, ‘‘রেল কর্তৃপক্ষ প্রতিবার মুখে নানা আশ্বাসের কথা বললেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তাই এই হকাররা মরিয়া হয়ে আমাদের না জানিয়েই আন্দোলনে নেমে পড়েন।’’

ঝাটনবাবুর কথায়, ‘‘চার মাস ধরে আয় নেই। সংসার আর চলছিল না। তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে বাধ্য হয়েই প্ল্যাটফর্মে ব্যবসা করতে শুরু করে দিয়েছিলাম।’’

সমরেশবাবুর বাড়ি উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ শহরে। তাঁর তিন বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। সে এখনও জানে না, বাবা নেই। সমরেশবাবুর শ্বশুর অর্ধেন্দু সরকার বলেন, ‘‘লাইসেন্সহীন হকারেরা সরকারি কর্মীদের উপরে কেন চড়াও হলেন, তা বুঝতে পারছি না। আমার মেয়ের সংসার ভেসে গেল।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE