পুরীর জগন্নাথধামের ভোগের সাক্ষ্য অবধি দাখিল করা হয়েছিল বাংলার রসগোল্লার বিরুদ্ধে। কিন্তু ধোপে টিকল না কোনও যুক্তিই।
রসগোল্লার হক নিয়ে ওডিশার সঙ্গে কাজিয়ায় শেষমেশ বাংলার হাসিই চওড়া হল। এ দেশে জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (জিআই)-সংক্রান্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার চিন্নারাজা জি নায়ডু মঙ্গলবার চেন্নাই থেকে ফোনে বললেন, ‘‘বাংলাই রসগোল্লার আঁতুড়ঘর! ওডিশার দাবি নিয়ে বিতর্কটাই ফালতু!’’ বছর দুয়েক আগে পুরীতে জগন্নাথদেবের নবকলেবরের আগে থেকে ওডিশার রসগোল্লার প্রাচীনত্ব নিয়ে তাল ঠোকাঠুকি শুরু হয়। কটকের কাছে পাহালের রসগোল্লাই আদি রসগোল্লা বলে দাবি করে জিআই-আদায়ের জন্য প্যানেল গড়েছিল ওডিশা। কিন্তু গর্জালেও ততটা বর্ষায়নি তারা। বরং নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে রসগোল্লার জিআই-এর জন্য আর্জি পেশের কাজ সেরে ফেলে বাংলা। জিআই কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়ম মেনে পেশ করা হয় কলকাতা-সহ বিভিন্ন জেলার রসগোল্লা নমুনাও।
মিষ্টিমুখ: বাংলার রসগোল্লা চেখে দেখছেন মার্কিন কনসাল জেনারেল ক্রেগ হল এবং তাঁর স্ত্রী মিরইয়ুং হল। মঙ্গলবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
তার ফল মিলেছে এ দিন। বিলেতে বসেই টুইট করে এই ‘মিষ্টি খবরে’ তৃপ্তি প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর ওডিশার অর্থমন্ত্রী শশিভূষণ বেহরা বলেন, ‘‘একতরফা বাংলার কথা শুনে জিআই-তকমা দেওয়াটা ঠিক হয়নি। আমরা এর পরেও আর্জি জানাব!’’ পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের প্রাচীন রীতিকে হাতিয়ার করেই কোমর বাঁধছিল ওডিশা।
রসগোল্লা-কথা
মে, ’১৫: কটকের কাছে পাহালের রসগোল্লাই আদি রসগোল্লা বলে দাবি করে জিআই তকমা আদায়ে তৎপর ওডিশার ক্ষুদ্র শিল্প মন্ত্রক
অগস্ট, ’১৫: ওডিশাকে রুখে রসগোল্লার স্বত্ব আদায়ে গবেষণাপত্র তৈরির তৎপরতা বাংলার খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি মন্ত্রকের
১৬ সেপ্টেম্বর, ’১৫: জিআই আদায়ের আর্জি পেশ বাংলার।
১৫ জুলাই, ’১৬: বিশেষজ্ঞদের ১০০ পাতার রিপোর্টের ভিত্তিতে পুরীর মন্দিরের সঙ্গে ৫০০ বছরের পুরনো রসগোল্লা-যোগের দাবি পেশ ওডিশার।
২২ অগস্ট, ’১৬: বাংলার রসগোল্লার হয়ে জিআই কন্ট্রোলারের সামনে শুনানি
২ অগস্ট, ’১৭: জিআই আদায়ে প্যানেল গঠন ওডিশার।
নভেম্বর, ’১৭: জিআই কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলার বিভিন্ন জেলার রসগোল্লার নমুনা পেশ
১৪ নভেম্বর, ’১৭:ওডিশার আর্জি পেশের আগেই জিআই তকমা জয় বাংলার রসগোল্লার।
উল্টোরথের দিন রসগোল্লা-উৎসব পুরীর প্রাচীন পরম্পরা। স্ত্রী লক্ষ্মীকে ফেলে দু’হপ্তার ছুটি কাটিয়ে মন্দিরে ফিরে রসগোল্লা খাইয়েই লক্ষ্মীর মান ভাঙান জগন্নাথদেব। এ প্রথা এখনও বহাল পুরীর মন্দিরে। পাহালের প্রসিদ্ধ রসগোল্লাকার বিকলানন্দ করের বংশধর প্রশান্ত কর এ দিনও সেই পুরনো প্রথার কথা মনে করিয়ে দেন। কিন্তু বাঙালির কাছে ‘রসগোল্লার কলম্বাস’ নবীন দাশের নাতির নাতি ধীমান দাশের বক্তব্য, সে-রসগোল্লা এ রসগোল্লা নয়। বাংলার ইতিহাস গবেষকদেরও দাবি, ওডিশার মন্দির-সংক্রান্ত কোনও নথিতেই রসগোল্লার উল্লেখ নেই। ক্ষীরমোহন বলে কোনও মিষ্টির সঙ্গে রসগোল্লার মিল থাকতে পারে।
জিআই কী
কোনও ভৌগোলিক অঞ্চলের পরম্পরা বা সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত বিশেষ পণ্যের স্বীকৃতি হল জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (জিআই) তকমা। এই স্বীকৃতির সুবাদে পণ্যটির কৌলীন্য বাড়ে। বিপণনের সুবিধে হয়।
যেমন, মেক্সিকোর পানীয় তেকিলা, দার্জিলিঙের চা বা মহীশূরের রেশম।
জিআই কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: রসগোল্লার বয়স খুব বেশি হলে ১৫০ বছর। বাগবাজারের নবীন দাশ বা ফুলিয়ার হারাধন ময়রাদের হাতে তার শ্রীবৃদ্ধি। তা ছাড়া, মধ্য যুগে দুধ ছিন্ন করে সৃষ্ট ছানা দেবতার নৈবেদ্যর উপযোগী নয় বলেই ধরা হতো। ছানা থেকে খাদ্যসামগ্রী তৈরির কৌশল সপ্তদশ শতকে বাংলাকে শেখায় পর্তুগিজরা। পরে ছানা দিয়ে মিষ্টি সৃষ্টির কারিকুরি একান্তই বাংলার। বাংলার রসগোল্লার বৈশিষ্ট্য হিসেবে, নিখাদ গরুর দুধের ছানা ও চিনির রসের উপাদানের কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
‘বিশ্ব ডায়াবিটিস দিবসে’ বাংলার জন্য এ হেন স্বীকৃতি আদায় নিয়ে হাসিঠাট্টা চললেও রসগোল্লার এই জয়ে দলমত নির্বিশেষে হাসছে বাংলা। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু অবধি সরকারের কাছে সবাইকে রসগোল্লা খাওয়ানোর আবদার জানিয়ে রেখেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy