বাংলাদেশে থেকে ভারতে ঢুকছে মাথাভাঙা। কৃষ্ণগঞ্জের গোবিন্দপুরে।
একটা সময় নাকি ছিল, এ নদীর জল ছিল স্বচ্ছতোয়া। তার তল দেখা যেত নাকি কোথাও-কোথাও।
সে সব কবেই অতীত। এখন সে নদীর জল ঘুলিয়ে উঠছে দূষণে। থেকে থেকেই মরে ভেসে উঠছে মাছ। নদীর দু’পাড়ের মানুষ অনেক দিন ধরেই এই নিয়ে সরব। দিল্লি থেকে ঢাকা পর্যন্ত দরবারও কম হয়নি। কিন্তু লাভ কিছু হয়নি এখনও।
কৃষ্ণগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে রানাঘাট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার জীবনধারা যে নদী, কী ভাবে তা দূষিত হচ্ছে, কেনই বা তা রোখা যাচ্ছে না তার ইতিবৃত্ত দীর্ঘ। কিন্তু সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে নদীর চলার পথটি আগে একটু বুঝে নেওয়া জরুরি।
চূর্ণী এক দিক দিয়ে আদ্যোপান্ত নদিয়ারই নদী। উত্তরে করিমপুরের কাছে হোগলবেড়িয়ায় পদ্মার শাখা থেকে উৎপত্তি মাথাভাঙার। মুরুটিয়া পেরিয়ে শেখপাড়া মেঘনা হয়ে তা চলে গিয়েছে বাংলাদেশে। সেখানে কিছু দূর চলার পরে কৃষ্ণগঞ্জ হয়ে তা ফের এ দেশে ঢুকেছে। সীমান্ত থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার উজিয়ে তা গোবিন্দপুর হয়ে এসেছে পাবাখালি। সেখানেই মাথাভাঙা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে— পুবে গিয়েছে ইছামতী আর পশ্চিমে চূর্ণী।
ইছামতী দক্ষিণে নেমে উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ হয়ে বাংলাদেশে চলে গিয়েছে। পরে হাসনাবাদের কাছে ফের এ দেশে ঢুকে সুন্দরবনের পথে নাম নিয়েছে কালিন্দী। আর চূর্ণী কৃষ্ণগঞ্জ ব্লক পার করে হাঁসখালি, রানাঘাট ২ ও রানাঘাট ১ ব্লকের একাংশ দিয়ে বয়ে পায়রাডাঙার কাছে ভাগীরথীতে গিয়ে পড়েছে।
পাবাখালির কাছে মাথাভাঙা ভাগ হয়ে ইছামতী বেরিয়ে এলেও এখন তা মূল নদী থেকে কার্যত বিচ্ছিন্নই। উৎস থেকে ইছামতীর দূরত্ব এখন কয়েকশো মিটার। মাঝের জমিতে দিব্যি চাষবাসও হয়। নদী বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম কর্মকার বলছেন, “ইছামতী আগে ইন্দুমতী নামে নদী থেকে জল পেত। মাথাভাঙার সঙ্গে এখন আর ইছামতীর যোগ নেই।” বৃষ্টির জল আর মাটির নীচ থেকে চুঁইয়ে আসা জলই তার ভরসা।
পাবাখালিতে মাথাভাঙা থেকে বেরোল চূর্ণী।
অর্থাৎ বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে বয়ে আসা মাথাভাঙার পুরো জলটাই কার্যত চূর্ণী দিয়ে বয়ে যায় এখন। ফলে, দূষণের বিষও তাকেই বইতে হয়। চূর্ণী তীরবর্তী এলাকার মানুষের বহু দিনের অভিযোগ, বাংলাদেশের দর্শনার একটি চিনিকল ও অন্য একটি কারখানা থেকে নিয়মিত বর্জ্য পদার্থ ফেলা হয় মাথাভাঙায়। তা বয়ে আসে এ দেশে, পরে চূর্ণী হয়ে ভাগীরথীর দিকে চলে যায়।
কিন্তু শুধু তা-ই নয়। আরও বেশ কিছু জিনিস চূর্ণীর দূষণকে ত্বরান্বিত করছে। যেমন বিভিন্ন জায়গায় বাধাল দিয়ে মাছ ধরার কাজ চালানো হয়। এতে নদীর স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হচ্ছে। গতিশীলতার ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। একে তো পলির চাপে ক্রমশ অগভীর হচ্ছে নদীখাত। সুপ্রতিম জানাচ্ছেন, ‘প্রিজার্ভেশন অব পোর্ট অফ ক্যালকাটা’র তথ্য অনুযায়ী, চূর্ণী প্রতি বছর বয়ে আনে প্রায় ১৫ লক্ষ টন পলি। নদী যত দক্ষিণের দিকে যাচ্ছে, ততই তার গভীরতা কমছে।
ভাগীরথীতে মিশছে চূর্ণী। পায়রাডাঙায়।
চূর্ণীতে এখন ভেসে আসছে প্রচুর কচুরিপানা। তা-ও জলের অক্সিজেন টেনে নিচ্ছে, স্রোতকে বাধা দিচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে জলজ প্রাণীদের। রানাঘাট ১ ও ২ ব্লকের নানা ইটভাটা, ছোট কারখানা থেকে বর্জ্য এসে পড়ছে চূর্ণীতে। এসে পড়ছে রানাঘাট শহরের বিপুল পরিমাণ বর্জ্যও।
চূর্ণীর দূষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে ‘মাথাভাঙা চূর্ণী রিভার রেসকিউ কমিটি’। সেটির অগ্রণী সদস্য স্বপন ভৌমিক, বিবর্তন ভট্টাচার্যেরা বারবার এই বিষয়গুলি তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। তা হয় আন্তর্জাতিক সমীকরণে ধাক্কা খাচ্ছে, অথবা কর্তাদের অনিচ্ছার দেওয়ালে।
সম্প্রতি একটি অসরকারি সংস্থা জেলার বিভিন্ন জায়গায় মাথাভাঙা এবং চূর্ণী নদী থেকে জলের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছে। কিন্তু সেচের জলে বাহিত হয়ে দূষণ বিষ যে মিশতে পারে ফসলেও, সেই খেয়াল কি আছে?
ছবি: প্রণব দেবনাথ ও সুদীপ ভট্টাচার্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy