জমি নয়। আর্থিক সুবিধা নয়। বিশেষ আর্থিক অঞ্চলের (সেজ) তকমাও নয়। পূর্ব মেদিনীপুরের রসুলপুরে দীর্ঘ দিন আটকে থাকা গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির কাজ দ্রুত শুরু করতে শুধু জমির মানচিত্র ও প্রয়োজনীয় তথ্যটুকু চেয়েছিল তা গড়তে আগ্রহী সংস্থা। কিন্তু তাদের অভিযোগ, দু’মাস কেটে যাওয়ার পরও সেই তথ্য দেয়নি পূর্ত দফতর। লাভ হয়নি তিন দফতরের (পূর্ত, ভূমি ও ভূমি সংস্কার এবং শিল্প) কাছে এ নিয়ে দরবার করে। সমস্যা জেনেও এগিয়ে আসেনি শিল্প দফতর। রাজ্যে রাজ্যে বিনিয়োগ টানতে সম্প্রতি সিঙ্গাপুর পর্যন্ত দৌড়েছে যারা। লগ্নি টানতে একের পর এক কমিটি আর টাস্ক ফোর্স গড়ছে রাজ্য সরকার। অথচ এখানে অন্তত ছ’হাজার কোটি টাকার লগ্নি প্রস্তাব থমকে রয়েছে স্রেফ প্রশাসনিক উদাসীনতায়!
এই বন্দর গড়তে আগ্রহী মেকা গোষ্ঠীর শাখা সংস্থা আম্মালাইন্সের দাবি, এই প্রকল্পের জন্য জুনপুট থেকে কাঁথি পর্যন্ত ৯ কিলোমিটার রাস্তা চওড়া করা জরুরি। কারণ, বন্দর হলে সেখানে যাবতীয় পণ্য যাবে ওই রাস্তা ধরে। কিন্তু এখন এই রাস্তা মাত্র দেড় লেনের। কমপক্ষে যা তিন লেনের না-হলে, পণ্য পরিবহণ অসম্ভব। সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর, সরকার আগেই বহু জমি অধিগ্রহণ করে রাখায় ওই রাস্তা চওড়া করতে নতুন করে জমি নেওয়ার প্রয়োজন তেমন নেই। কিন্তু দরকার অধিগৃহীত ওই জমির মানচিত্র। না হলে রাস্তার কাজ এগোনো যাবে না। সংস্থার অভিযোগ, কেন্দ্র এবং নিজেদের টাকায় রাস্তা চওড়া করতে তৈরি তারা। কিন্তু তা আটকে আছে মানচিত্র হাতে না পাওয়ার কারণেই।
মোট ১৩টি মৌজার জমি এই রাস্তায় রয়েছে। দক্ষিণ রামপুর, দক্ষিণ গোপিনাথপুর, খাকিনা, বেনিপুর, বিচুনিয়া-সহ ওই সব মৌজার জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে আগেই। গত জুলাইয়ে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর, পূর্ত দফতর এবং শিল্প দফতরের কাছে তার মানচিত্র ও বিবরণ চেয়েছিল আম্মালাইন্স। কিন্তু সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর মেকা পাপা রাওয়ের অভিযোগ, “তথ্য দিতে এগিয়ে আসেনি কোনও দফতরই।”
এ প্রসঙ্গে পূর্তসচিব ইন্দিবর পান্ডে জানান, যে কোনও শিল্প প্রকল্পের প্রস্তাব শিল্প দফতরের মারফতই আসতে হবে। তারা সুপারিশ করলেই তা করে দেবে তাঁর দফতর। কিন্তু তা হলে শিল্প দফতর এ নিয়ে কিছু জানায়নি কেন? এ বিষয়ে শিল্পমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসার জন্য ফোন করলেও, তিনি তা ধরেননি। উত্তর মেলেনি এসএমএসেরও।
শিল্পমহলের প্রশ্ন, যেখানে রাজ্যে বড় বিনিয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে, সেখানে হাতে থাকা লগ্নি প্রস্তাবকে সামান্য এই তথ্যটুকু দিতে প্রশাসন এত উদাসীন কেন? বিশেষত যেখানে কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরের দশা বেহাল। এবং এই পরিস্থিতিতে নতুন গভীর সমুদ্র বন্দর কিছুটা হলেও অক্সিজেন জোগাতে পারত রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতিতে।
রসুলপুরে বন্দর গড়তে ২০০৭ সালে তৎকালীন বাম সরকারের কাছে আগ্রহ পত্র জমা দেয় আম্মালাইন্স। ২০০৮ সালে প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যেতে রাজ্যকে সবুজ সঙ্কেত দেয় কেন্দ্রও। এর পর ২০১০ সালে সংস্থার হাতে লেটার অব ইনটেন্ট তুলে দেয় রাজ্য। তাতে পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র পাওয়া থেকে শুরু করে প্রকল্পের বিস্তারিত পরিকল্পনা ও খরচ জানানোর দায় চাপে সংস্থার উপরই। সেই অনুযায়ী ২০১০ সালের অগস্টে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের কাছে খসড়া চুক্তিপত্র পাঠায় আম্মালাইন্স। কিন্তু তার শর্ত নিয়ে চাপানউতোরের কারণে চুক্তি সই হয়নি। এর পর বিধানসভা ভোট এসে পড়ায় বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়।
একই সঙ্গে প্রকল্পের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবেশ সংক্রান্ত বিধি-নিষেধও। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে হলদিয়ায় শিল্প প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে পরিবেশ নিয়ে কেন্দ্রীয় নিষেধাজ্ঞা চালু হয়। আটকে যায় রসুলপুরের ছাড়পত্র। ২০১৩-এর সেপ্টেম্বরে নিষেধাজ্ঞা ওঠে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর, এর পর গত নভেম্বরে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞ কমিটির সামনে যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দেন আম্মালাইন্সের প্রতিনিধিরা। সংস্থার দাবি, সেই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়ে প্রাথমিক সবুজ সঙ্কেত ডিসেম্বরেই দিয়েছে কমিটি।
এখন এত কিছুর পর রাস্তা সম্প্রসারণের জমির মানচিত্র না পাওয়ায় ফের আটকে গিয়েছে প্রকল্প। অথচ বন্দর পরিকাঠামো গড়ায় দক্ষ আম্মালাইন্সের দাবি, যে প্রযুক্তিতে বন্দরের চ্যানেল তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার পেটেন্ট রয়েছে তাদের হাতে। এর আগে এই একই ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে মহারাষ্ট্রে মুকেশ অম্বানীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রেওয়াস বন্দর তৈরি করেছে তারা। সংস্থার দাবি, রেওয়াসে নাব্যতা যেখানে ১৬ মিটার, রসুলপুরে তা দাঁড়াবে ১৮ মিটার।
কিন্তু এখন বন্দর বা তার নাব্যতা দূর অস্ৎ। প্রকল্প থমকে রয়েছে সরকারি ফাইলের পলিতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy