উত্তপ্ত আরজি কর হাসপাতাল। —ফাইল চিত্র।
টালা থানা। এফআইআর নম্বর ৫২। ‘ফার্স্ট কন্টেন্টস’ কলমে লেখা, ‘আননোন মিসক্রিয়েন্টস কমিটেড উইলফুল রেপ উইথ মার্ডার’। অর্থাৎ, অজ্ঞাতপরিচয় কেউ ইচ্ছাকৃত ধর্ষণ এবং খুন করেছে।
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক-পড়ুয়াকে খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় বিতর্কে থাকা এফআইআরে এমনই লেখা রয়েছে।
কলকাতা হাই কোর্ট এবং পরে সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুলেছিল, কেন সকাল ১০টা নাগাদ ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছে গেলেও রাত পৌনে ১২টায় এফআইআর দায়ের করা হল? মৃতদেহে যেখানে সহজেই একাধিক আঘাতের চিহ্ন দেখা গিয়েছে, সেখানে প্রথমেই খুনের ধারায় এফআইআর দায়ের না করে পুলিশ কেন অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করে রাত পর্যন্ত তদন্ত চালিয়ে গেল? শুক্রবার এই এফআইআরের কাগজ হাতে আসার পর দেখা যাচ্ছে, প্রশ্ন রয়েছে আরও বেশ কিছু। প্রশ্ন তুলছেন আন্দোলনকারী চিকিৎসক, আইনজীবীদের বড় অংশই। তাঁদের দাবি, আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয়, এফআইআর-এ লেখা হয়েছে ‘উইলফুল রেপ’। অথচ আইনি পরিভাষায় ‘ইচ্ছাকৃত রেপ’ বলেকিছুই নেই।
দেখা যাচ্ছে, ঘটনার দিন অর্থাৎ ৯ অগস্ট রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে এফআইআরটি করা হয়েছে। ৫৭৭ নম্বর জিডি বা জেনারেল ডায়েরির ভিত্তিতে এই এফআইআর। এই ঘটনায় যে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা (আনন্যাচারাল ডেথ বা ইউডি) করে পুলিশ এগিয়েছিল, সেই ৮৬১ নম্বর ইউডি কেসেরও উল্লেখ করা হয়েছে এখানে। সেই সঙ্গে লেখা হয়েছে, ঘটনাস্থল থানা থেকে ৭৫০ মিটার দূরে। বেলা ১০টা ১০ মিনিটের আগে কোনও এক সময়ে এই খুন এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ধারা হিসেবে লেখা হয়েছে, ভারতীয় ন্যায় সংহিতার (বিএনএস) ৬৪ এবং ১০৩ (১)। নতুন আইন অনুযায়ী, বিএনএস ৬৪ হল ধর্ষণের ধারা এবং ১০৩ (১) হল এক জনের দ্বারা সংগঠিত খুনের ধারা। এফআইআরে এ-ও লেখা হয়েছে, ‘পরিবারের থেকে পাওয়া অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে এই এফআইআর। সেই অভিযোগপত্রকেই এফআইআর হিসাবে ধরা হয়েছে’।
এখানেই প্রশ্ন আন্দোলনকারী চিকিৎসক এবং আইনজীবীদের অনেকের। প্রশ্ন তুলছে খোদ মৃতের পরিবারও। তাঁদের দাবি, টালা থানার ওসি-কে তাঁদের দেওয়া অভিযোগপত্রে লেখা রয়েছে, ‘আপনার কাছে একান্ত অনুরোধ, আমার একমাত্র কন্যাসন্তানকে নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর যে হত্যা করা হয়েছে, যে বা যারা এর সাথে যুক্ত, দ্রুত তদন্ত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।’ ফলে তাঁদের প্রশ্ন, পুলিশ যদি এই অভিযোগপত্রের ভিত্তিতেই এফআইআর করে থাকে, তা হলে ধর্ষক বা খুনি এক জনই ধরে নেওয়া হল কেন? মৃতার মায়ের দাবি, “প্রথম থেকে মনে হচ্ছে, আমার মেয়েকে এই ভাবে এক জনের পক্ষে মারা সম্ভব নয়। সেই কারণেই অভিযোগপত্রে যে বা যারা জড়িত লিখেছিলাম। তার পরেও কেন শুধু এক জনই অপরাধী ধরে নিয়ে এফআইআর করা হল?”
আইনজীবী এবং আন্দোলনকারী ডাক্তারেরা এই প্রেক্ষিতেই তুলছেন ময়না তদন্তের প্রসঙ্গ। তাঁদের দাবি, যে ময়না তদন্ত হয়েছে, তাতে লেখা হয়েছে, ‘দেয়ার ইজ় মেডিক্যাল এভিডেন্স সাজেস্টিং ফোর্সফুল পেনিট্রেশন/ ইনসার্সন ইন দ্য জেনেটালিয়া, ইন্ডিকেটিং দ্য পসিবিলিটি অব সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট’। জেনেটালিয়া অর্থাৎ যোনিদ্বার দিয়ে কিছু প্রবেশ করানোর প্রমাণ মিলেছে। যৌন নির্যাতন করা হয়ে থাকতে পারে। তবে ময়না তদন্তে সরাসরি ধর্ষণের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
এক আন্দোলনকারী চিকিৎসক বলেন, “কেন অত দেরিতে ময়না তদন্ত করা হল, এই প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ যুক্তি দিয়েছিল, ময়না তদন্তে কী পাওয়া যাচ্ছে বুঝে, সেই মতো এফআইআর লেখাই ভাল। বরাবর সব জায়গায় এই মতো কাজ হয়েছে। এখানেও সেটাই মানা হয়েছে। তা হলে প্রশ্ন ওঠে, ময়না তদন্তে তো ধর্ষণের কথা লেখা হয়নি। এক জন ধর্ষক, না কি একাধিক জন জড়িত, সে ব্যাপারেও তো ময়না তদন্ত থেকে স্পষ্ট দিগনির্দেশ মেলেনি। তা হলে ময়না তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট জানার পরে এফআইআর করতে গিয়ে পুলিশ কী করে লিখল ‘উইলফুল রেপ’, যা এক জনই করেছে?”
আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “উইলফুল রেপ বলে কিছু হয় না। অত্যন্ত হাস্যকর ব্যাপার। এটা কোনও আইনের ভাষা নয়। পুলিশ কী করে এটা লিখল জানি না। চার্জশিট জমা না পড়া পর্যন্ত এফআইআর গুরুত্বপূর্ণ। তারপর এই বক্তব্যের আর কোনও গুরুত্ব থাকবে না। আসল কথা হল, ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য যে যে নমুনা পাঠানোর কথা, তা পাঠানো হয়েছিল কি? তার রিপোর্ট কী এল? ৪০ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যথাযথ ভাবে নমুনা না পাঠানো এবং দীর্ঘ সময় পরে রিপোর্ট আসার জন্য বহু ক্ষেত্রেই ডিসইন্টিগ্রেটেড রিপোর্ট আসে। অর্থাৎ যথাযথ রিপোর্ট মেলে না। এ জন্য ঠিকমতো সাজা হয় না।” সূত্রের খবর, এই সব নজরে রেখে তদন্ত চালাচ্ছে সিবিআই। বাদ যায়নি এফআইআরে লেখা বয়ানও। পুলিশ ও পরিবারকে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এফআইআর নিয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy