বোলপুর হাসপাতালে নিহতের পরিবার। —নিজস্ব চিত্র।
ফের তৃণমূলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বে রক্তাক্ত নানুর!
দিনের আলোয় পঞ্চায়েত অফিসের সামনে তৃণমূলকর্মীকে কুপিয়ে খুন করে চম্পট দিল দুষ্কৃতীরা। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা নাগাদ কীর্ণাহার ১ পঞ্চায়েত অফিসের সামনের ওই ঘটনায় নাম জড়াল দলেরই জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ডানহাত বলে পরিচিত অভিজিত্ সিংহের (রানা)। পুলিশ জানায়, নিহত আখের আলির (৩৬) বাড়ি স্থানীয় কাফেরপুর গ্রামে। নিহত ওই তৃণমূল কর্মী দলের জেলা সভাপতির অনুগামীদের বিরোধী বলে পরিচিত, নানুরের দাপুটে তৃণমূল নেতা কাজল শেখ (কেতুগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজের ভাই) গোষ্ঠীর হয়ে কাজ করতেন।
এ দিনই নিহতের সঙ্গী এবং নিজেকে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করে কাফেরপুরেরই মানোয়ার শেখ অভিজিত্ সিংহ-সহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন। তৃণমূলের জেলা কমিটির সদস্য অভিজিত্বাবু অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। জেলার পুলিশ সুপার মুকেশ কুমারের দাবি, “এখনও পর্যন্ত অভিযোগ জমা পড়েনি। পুলিশ আপাতত একটি খুনের মামলা রুজু করে তল্লাশি চালাচ্ছে।”
বস্তুত, নানুরে তৃণমূলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বকে ঘিরে এমন রক্ত ঝরা, নতুন কোনও ঘটনা নয়। দল ও স্থানীয় সূত্রের খবর, কাজলের সঙ্গে অনুব্রতর অনুগামীদের বিরোধ দীর্ঘ দিনের। নানুরের বড় অংশের পঞ্চায়েত চলে কাজলের অঙ্গুলিহেলনেই। এ নিয়ে মাঝে মধ্যেই দু’পক্ষের বিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দু’পক্ষের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন সময়ে দলের ব্লক কার্যালয়ে হামলা চালানো এবং নেতা-কর্মীদের মারধরের অভিযোগও উঠেছে। ইতিপূর্বে কীর্ণাহার ১ পঞ্চায়েত এলাকাও শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব দেখেছে। পঞ্চায়েতের প্রধান শিবরাম চট্টোপাধ্যায় এলাকায় জেলা সভাপতি গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। গত জানুয়ারি মাসেই দু’ দফায় তাঁর বাড়ি লক্ষ্য করে বোমা মারার অভিযোগ উঠেছিল বিরোধী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ওই পঞ্চায়েতের সামনেই পলাশ শেখ নামে এক কাজল গোষ্ঠীর অনুগামীকে খুনের চেষ্টার অভিযোগ ওঠে দলের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
ঠিক কী ঘটেছিল এ দিন?
মানোয়ার তাঁর লিখিত অভিযোগে দাবি করেছেন, এ দিন সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ তাঁকে মোটরবাইকে চাপিয়ে আখের আলি কীর্ণাহার ১ পঞ্চায়েতের সামনে বাসস্ট্যান্ডে একটি চায়ের দোকানে যান। সেখানে চা খেয়ে বেরিয়ে আসার সময়ে নজরুল শেখ, নুরমান শেখ, কুলু শেখ-সহ কয়েক জন দুষ্কৃতী তাঁদের পথ আটকায়। মানোয়ারের দাবি, “আখেরকে নুরমান হুঙ্কার দিয়ে বলে, ‘রানা সিংহের নির্দেশ আছে, তোকে এখানেই শেষ করে দেব’। সঙ্গে সঙ্গে সে একটা বড় হাতুড়ি দিয়ে আখেরের মাথার পিছন দিকে আঘাত করে।” রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়েন ওই তৃণমূল কর্মী। ওই সময় নুরমান কোমর থেকে পিস্তল বের করে আখেরের উপরে পরপর গুলি চালায় বলে তাঁর দাবি। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে কুলু এবং বাকি দুষ্কৃতীরা টাঙ্গি, হাঁসুয়া, ভোজালি দিয়ে মৃতপ্রায় আখেরের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কোপাতে শুরু করে। ওই সময়েই তিনি কোনও রকমে ছুটে পালিয়ে প্রাণ বাঁচান বলে মানোয়ার ওই লিখিত অভিযোগে দাবি করেছেন।
দল ও স্থানীয় সূত্রের খবর, অতীতে কীর্ণাহার ১ ও ২ এবং দাসকলগ্রাম-কড়েয়া ১ ও২ পঞ্চায়েত এলাকায় তৃণমূল তথা বাম বিরোধীদের তেমন কোনও অস্তিত্ব ছিল না। সে সময় এলাকা তথা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে সিপিএমের সঙ্গে শরিক দল আরএসপি, কিংবা ফরওয়ার্ড ব্লকের সংঘর্ষ লেগেই থাকত। তত্কালীন ফব-র দাপুটে নেতা সম্পর্কিত দুই ভাই, বিশ্বজিত্ ওরফে কর্পূর এবং রানা সিংহের নেতৃত্বে সিপিএমের সঙ্গে সমানে টক্করও হয়েছে। পরে কর্পূর সিপিএমে যোগ দেন। খুনের দায়ে বর্তমানে জেল খাটছেন। গত বিধানসভা ভোটের পরে তৃণমূলে যোগ দেন রানা।
এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে কাফেরপুর গ্রামেও। নিহত আখের আলির পরিবার একসময় আরএসপি-র সমর্থক ছিল। পরে ফব-তে নাম লেখান। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে কাজলের নেতৃত্বে তৃণমূলে যোগ দেন। তার পর থেকে গ্রামেরই এক সময়ের দাপুটে সিপিএম নেতা হুড়মুদ শেখের সঙ্গে তাঁদের বিরোধ চরমে ওঠে বলে খবর। গত জুন মাসে হুড়মুদের উপরে হামলা চালানোর অভিযোগও ওঠে আখের আলিদের বিরুদ্ধে। বদলা নেওয়ার জন্য হুড়মুদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে ওই সময় বোমা বাঁধতে গিয়ে একজনের মৃত্যুও হয় বলে পুলিশ সূত্রের দাবি। তার পরেই হুড়মুদও তৃণমূলে কাজলের বিরোধী গোষ্ঠীতে নাম লেখান বলে জানা গিয়েছে।
এ দিন দুপুর ১২টা নাগাদ গিয়ে অবশ্য দেখা গেল কার্যত জনমানব শূন্য গোটা কাফেরপুর গ্রাম। হুড়মুদ এবং আখের আলির বাড়িতেও কারও দেখা মেলেনি। গ্রামে পুলিশ টহল চলছে। লাগোয়া মহেশগ্রামের বাসিন্দারা জানান, ওই খুনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরেই গ্রামে দু’পক্ষের ব্যাপক বোমাবাজি হয়। তার পর পুলিশ আসতেই সকলে গ্রাম ছেড়ে পালায়। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য, অনুব্রত অনুগামী হিসাবে পরিচিত রুস্তম খান বলেন, “দু’পক্ষই আমাদের দলে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ কাউকে মেনে নিতে পারছিলেন না। পুরনো বিবাদ তো ছিলই। হয়তো কর্তৃত্ব দখলের বিরোধও মাথাচাড়া দিয়ে থাকবে।” পরে বোলপুর হাসপাতালে আখের আলির স্ত্রী মমতাজ বেগম জানান, স্বামী কীর্ণাহারে বিদ্যুত্ বিল জমা দিতে যাচ্ছি বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। কিছু ক্ষণের মধ্যেই স্বামীকে এ ভাবে খুন করার খবর পান। তাঁর অভিযোগ, “হুড়মুদরা ওকে খুন করেছে। সিপিএমে থাকার সময়ে ওরা আমাদের উপর অত্যাচার করেছে। আমার স্বামী তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর এঁটে উঠতে পারছিল না বলে হুড়মুদও বিরোধী গোষ্ঠীতে যোগ দেয়।”
এ দিনের খুনের পরে রানার দিকেই আঙুল তুলেছেন তৃণমূল নেতা কাজল শেখও। তাঁর দাবি, আখের আলির জন্যই রানার লোকেরা পায়ের তলায় মাটি হারাচ্ছিল। তাই তাঁকে খুন করা হল। কাজলের বক্তব্য, “রানা এখন অনুব্রত মণ্ডলের আশ্রয়ে বড় তৃণমূলের নেতা হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু, তাতে কী হবে! ও আগেও সিপিএম ছিল, এখনও সেই হার্মাদই আছে। তাই এলাকায় খুনের রাজনীতি করছে। ওর পরিকল্পনাতেই আমাদের কর্মীকে খুন করা হয়েছে।” যদিও অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন রানা সিংহ। তাঁর পাল্টা দাবি, “আমি দীর্ঘ দিন ধরেই বোলপুরে বাস করছি। নানুরের রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে।”
অন্য দিকে, গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিলেন নানুরের তৃণমূল ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “এর সঙ্গে কোনও রাজনীতির সম্পর্ক নেই। হুড়মুদের সঙ্গে আখেরের পুরনো বিবাদ ছিল বলে শুনেছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy