নিয়ন্ত্রণহীন অঢেল ঋণ দেওয়ায় প্রতিটি শাখাতেই দু’ মাস আগে তালা ঝুলিয়েছে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। বীরভূম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের এই সঙ্কট গভীর প্রভাব ফেলেছে এই জেলার বিভিন্ন ক্ষেত্রের হাজার হাজার মানুষের প্রতিদিনের জীবনে। সাধারণ আমানতকারী, সমবায় সমিতি, এজেন্ট, প্রান্তিক চাষিরাই সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পও। অভিযোগ, লেনদেন বন্ধের জেরে উপভোক্তারা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ১০০ দিন কাজের প্রকল্প, মিড-ডে মিল, বার্ধক্য-বিধবা-অক্ষম ভাতা, রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনার (আরকেভিওয়াই) মতো বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের টাকাও তুলতে পারছেন না।
মিড-ডে মিলের ক্ষেত্রে কোথাও কিছু দিন বন্ধ থাকার পরে স্কুল কর্তৃপক্ষকে অন্য ব্যাঙ্কে খাতা খুলতে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে। কোথাও মিড-ডে মিল চলছে ধার করেই। আবার ১০০ দিন কাজের প্রকল্পের টাকা না পেয়ে সমবায় সমিতির ম্যানেজারদের শ্রমিকদের বিক্ষোভের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। রোজ সমিতিতে এসেও এক টাকাও না পেয়ে হয়রান হচ্ছেন বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, অক্ষম ভাতার উপভোক্তারাও। এই পরিস্থিতিতে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনিক কর্তারা দ্রুত সমস্যার সমাধান করার আশ্বাস দিলেও তাতে কোনও অংশই ভরসা পাচ্ছেন না। কারণ বাস্তব ঘটনা হল, টাকা তুলতে না পেরে আসন্ন ঈদের পরবে ছেলেমেয়েদের নতুন জামাকাপড় কিনে দিতে না পেরে মাথায় হাত পড়েছে গোলাম রসুলদের মতো জেলার বহু গরিব পরিবার।
এই গভীর সঙ্কট নিয়ে প্রশাসন চিন্তিত বলে দাবি জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীর। তিনি বলছেন, “এই জেলার বহু সমবায় সমিতিতে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কয়েক লক্ষ টাকা জমা রয়েছে। সমবায় ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেখান থেকে কোনও টাকাই তোলা যাচ্ছে না। এই সমস্যার মোকাবিলা কীভাবে করা যায়, সে ব্যাপারে আলোচনা চলছে। এ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে কাজ করব।” আবার ১০০ দিন প্রকল্পে জেলার নোডাল অফিসার বিশ্বজিৎ মোদক বলেন, “বিষয়টি এখন অত্যন্ত স্পর্শকাতর জায়গায় রয়েছে। রাজ্য প্রশাসনের লোজকজন সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছেন বলে জানি। আমরা বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাইকে অন্য ব্যাঙ্কের মাধ্যমে কাজ করতে পরামর্শ দিয়েছি।”
বীরভূমে ৩৩১টির মধ্যে একশোরও বেশি সমবায় সমিতিতে ব্যাঙ্কিং পদ্ধতি চালু আছে। জেলা জুড়ে সমবায় সমিতিগুলি থেকে মোট যে পরিষেবা পাওয়া যায় তার ৪৮ শতাংশই দেয় নলহাটি ১ ব্লকের বিভিন্ন সমবায় সমিতি। এমনকী, হিসেব বলছে, শুধু ২০১৩-’১৪ আর্থিক বছরে নলহাটি ১ ব্লকের ১৫টি সমবায় সমিতিই সব থেকে বেশি অনাদায়ী খেলাপি ঋণ আদায় করেছিল। নলহাটি ১ ব্লকের সমবায় পরিদর্শক অনুপকুমার বসাক জানান, কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কে ব্লকের সমবায় সমিতিগুলির প্রায় ২৪ কোটি টাকা জমা আছে। তার মধ্যে যেমন সমবায় সমিতিগুলির ফিক্সড ডিপোজিট বা ক্যাশ ক্রেডিট আছে, তেমনই সেভিংস ডিপোজিটও রয়েছে। ডিপোজিটগুলির মধ্যেই ১০০ দিনের কাজ, মিড-ডে মিল, আরকেভিওয়াই, বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতার লক্ষ লক্ষ টাকা আটকে আছে। তিনি বলেন, “যে সব সমিতির কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কেই অ্যাকাউন্ট আছে, তারা সব চেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়েছে।” এক দিকে খরিফ মরসুম, অন্য দিকে সামনেই রয়েছে ঈদ। এই পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অধুষ্যিত এই অঞ্চলের সমবায় সমিতি নির্ভর চাষি থেকে দিনমজুর— চড়া হারে অনেকেই মহাজনের থেকে সুদ নিতে ঝুঁকছেন বলে খবর।
কী বলছে সমবায় সমিতিগুলি?
অধিকাংশের সাফ কথা, রাজ্য সরকার এখনই এ নিয়ে হস্তক্ষেপ না করলে জেলার সমবায় সমিতিগুলি ডুবে যাবে। নলহাটি ১ ব্লকের বুজুং সমবায় সমিতির সমিতির বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৫১৫। সমিতির মাধ্যমে কেবল মাত্র বীরভূম জেলা সমবায় ব্যাঙ্কে ১ কোটি ৮১ লক্ষ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট জমা আছে। সেভিংস বাবদ জমা আছে ৮০ হাজার টাকা। সমিতির মাধ্যমে ব্যাঙ্কে গচ্ছিত আমানতের অন্যতম স্থানীয় বুজুং বিএনএ স্কুলের মিড-ডে মিলের ২ লক্ষ ৩৭ হাজার টাকা, বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা ও অক্ষম ভাতা বাবদ ৩১২ জন উপভোক্তার প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা ও ১০০ দিন প্রকল্পের প্রায় ১০ হাজার টাকা। ওই সমবায়ের ম্যানেজার ডালিম পাল বলছেন, “কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের লেনদেন বন্ধ থাকায় মানুষ নিজেদের টাকা পাওয়ার জন্য আমার কাছে হয়রান হয়ে ঘুরছে। আমাদের উপর ক্রমশ চাপ বাড়ছে। তাঁদের প্রাপ্য টাকা মিটিয়ে দেওয়ার জন্য বারবার প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছি। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না।” অন্য দিকে, বা বাউটিয়া সমবায় সমিতির ম্যনেজার নির্মল মণ্ডল জানান, তাঁরা একশো দিন কাজের প্রকল্পে শ্রমিকদের ৯ লক্ষ ৩১ হাজার টাকা ওই ব্যাঙ্কে জমা করেছেন। এলাকার শ্রমিকেরা ছ’মাস আগে করা ওই কাজের টাকা তুলতে না পেরে সমবায় সমিতিতে এসে বিক্ষোভও দেখিয়েছে। একই ভাবে আরকেভিওয়াই প্রকল্পে নলহাটি ১ ব্লকের আমাইপুর, বসন্ত, বানিওর— এই তিন সমবায় সমিতির প্রায় ২ লক্ষ ৭৫ হাজারেরও বেশি টাকা ব্যাঙ্কে জমা আছে।
ব্যাঙ্ক-জটে গত কয়েক মাস ধরে ১০০ দিন প্রকল্পের টাকা পাচ্ছেন না নলহাটি থানার চাচকা গ্রামের গোলাম রসুল, মইনুল হক, জসিমউদ্দিন শেখ, আব্দুল বারিদের মতো প্রায় সাড়ে তিনশো উপভোক্তা। গোলাম রসুল বলছেন, “আমরা দিনমজুর। প্রায় প্রতিদিনই টাকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছি। সামনেই ঈদ। টাকা পেলে ঈদের বাজার করতাম। েই অবস্থায় কার কাছে হাত পাতব!” বুজুং সমবায় সমিতিতে মিড-ডে মিল বাবদ বুজুং বিএনএ হাইস্কুলের দু’লক্ষেরও বেশি টাকা জমা আছে। স্কুলের পরিচালন সমিতির সম্পাদক প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “নিজেদের প্রাপ্য টাকা পাচ্ছি না। মিড-ডে মিল চালু রাখা নিয়ে সমস্যা তৈরি হওয়ায় অন্য একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে খাতা খুলতে হয়েছে।”
সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে আইনের সাহায্য নেওয়ার কথা ভাবছেন কোনও কোনও সমবায় সমিতির ম্যানেজার। বুজুংয়ের ডালিম পালরা তাই বলছেন, “এ ছাড়া আমাদের বাঁচার তো আর উপায় দেখছি না। রাজ্য সরকার সারদার মতো চিটফান্ডের সংস্থায় টাকা রাখা গ্রাহকদের কয়েকশো কোটি টাকা দিতে পারে। অথচ আমাদের মতো সরকারি ব্যাঙ্কে টাকা রেখে বিপাকে পড়া অংশের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসে না। আমাদের গ্রাহকেরা কী দোষ করেছিলেন? তাঁরা তো সরকারের উপরেই আস্থা রেখেছিলেন!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy