নাম ঘোষণার পরে। বোলপুরে বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরীর তোলা ছবি।
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে জেলার ‘বীরভূম’ এবং ‘বোলপুর’ এই দু’টি কেন্দ্রের জন্য তৃণমূল ও সিপিএম তাদের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করল বুধবার। শাসক ও বিরোধী দলের ঘোষণায় চমক নেই। তবে বীরভূম কেন্দ্রে তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরোধী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত শতাব্দী রায় প্রার্থী হবেন কি না, তা নিয়ে জল্পনা ছিলই।
কারণ, সদ্য প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়কে শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন উন্নয়ন পর্ষদ থেকে সরানো হয়েছিল ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর। ওই পদে বসানো হয় অনুব্রত-র ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহকে। শতাব্দী রায়ের সে সময় প্রতিক্রিয়া ছিল, নিজে থেকে সরে গিয়েছেন তিনি। এর পরে সিউড়ি এবং রামপুরহাটে জল প্রকল্পের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের হোর্ডিং-এ অনুব্রত-র ছবি থাকলেও শতাব্দীর ছবি কোথাও দেখা যায়নি। শুধু তাই নয়, শতাব্দীর অনুগামী হিসেবে পরিচিত সিউড়ির বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষের ছবিও দেখা যায়নি। একাধিক বার সিউড়ি-সহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় শতাব্দী রায় যখন দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন, তখন অনেক ক্ষেত্রেই অনুব্রত অনুগামী বলে পরিচিত নেতা বিশেষ করে মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ, লাভপুরের বিধায়ক মনিরুল ইসলাম, বর্তমান জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীদের ওই সভায় উপস্থিত থাকতে দেখা যায়নি। ওই সমস্ত সভায় শতাব্দী রায়কে বলতে শোনা গিয়েছিল, দলের মধ্যে ‘অর্ন্তদ্বন্দ্ব’ এবং ‘উপদল’ যাঁরা করবেন, তাঁরা দূরে থাকুন। আবার জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের নানান ‘হুমকি’র বিষয়ে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘কাউকে প্রাণে মেরে রাজনীতির দরকার নেই।’
এ ছাড়া, আবার শতাব্দী রায় যখন জেলা তৃণমূলের ‘দুই’ গোষ্ঠীর মধ্যে আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামী হয়েছিলেন। কিন্তু সেই আশিসবাবুকে সম্প্রতি শতাব্দী রায়ের বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। আশিসবাবু বলেছিলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে আমি কাজ করি। তার মতাদর্শে আমি চলি। তো কেউ যদি, তার বিরোধিতা করে, তার বিরোধিতা আমাকেও করতে হবে। শতাব্দী রায় দলীয় সংসদ হিসেবে সোমেন মিত্রের সভায় যেদিন গিয়েছিলেন, সেদিন থেকে আমার সঙ্গে ওনার মতানৈক্য দেখা দিয়েছে।”
তাই এ ফের টিকিট পাওয়া নিয়ে জল্পনা ছিলই। তবে গত কয়েক দিনে শতাব্দী রায় জেলায় যে কটি সভা করেছেন, সেখানে ফের প্রার্থী হওয়া নিয়ে তিনি আশাবাদী ছিলেন। বুধবার মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে শতাব্দী দেবী পরিষ্কার জানিয়ে দেন, “আগে থেকে জানতাম আমি প্রার্থী হচ্ছিই। তবে আমি ফের বীরভূম কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হওয়ায় কারও কারও খারাপ লাগবে। তাঁদের জন্য ‘আই অ্যাম সরি’।” এই কারও কারও কে সেটা অবশ্য তিনি ভেঙে বলেননি।
একই ভাবে বোলপুর কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী হাওয়া নিয়ে একটা কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল। জেলা সভাপতির খাসতালুক বোলপুরে তাঁর ঘনিষ্ঠ বোলপুরের উপপুরপ্রধান নরেশ বাউরিকে প্রার্থী করার জন্য নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল বলে শোনা যাচ্ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হন ৩২ বছরের যুবক শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা তথা বিশ্বভারতীর সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক অনুপম হাজরা।
জেলা সভাপতি গোষ্ঠীর লোকেরা মুখে কিছু না বললেও, শহরে কান পাতলেই এমনই শোনা যাচ্ছে কে অনুপম হাজরা? কোনও দিন তো দলীয় কার্যালয়ে বা দলের কোন কর্মসূচিতে যোগ দিতে দেখেননি কেউ। জেলার নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মুখে একই প্রশ্ন, তা হলে কী মুখ্যমন্ত্রী অন্য কোনও বার্তা দিতে চাইছেন? নাম ঘোষণার পর রাজ্যের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্মী দেবনাথ হাজরার ছেলে অনুপমবাবু জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহকে ফোনে প্রণাম জানিয়ে বলেন, “সমাজকর্ম, পঠনপাঠন ও অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে মা মাটি মানুষকে খুব ভাল চিনি এবং জানি তাদের উন্নয়নে আমার স্বতফুর্ততা থাকবে। বাকিটা ছেড়ে দিন মানুষের ওপর। কত মার্জিন হবে দেখতে হবে। আমি যথেষ্ট আশাবাদী। আমি এখনও ঘোরের মধ্যে রয়েছি। আসলে আমি ভাবতেই পারিনি মুখ্যমন্ত্রী আমাকে এরকম সুযোগ করিয়ে দেবেন।” তৃণমূলের দুই প্রার্থী সম্পর্কে বিরোধী দলের নেতারা কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। সিপিএমের জেলা সম্পাদক, দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “আমরা এর আগেও বলেছিলাম, বলিউড-টলিঊড তারকাদের নিয়ে এলাকার উন্নয়ন করা যায়নি। শতাব্দী রায় কী উন্নয়ন করেছে তা মানুষ ভাল ভাবে দেখেছেন। আবার তো উনি প্রার্থী। দেখা যাক কী হয়।” মিল্টন রসিদ (জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক) মন্তব্য, “শতাব্দী রায় আগে ছিলেন জোটের প্রার্থী। এ বার তিনি একা। দেখা যাক কী হয়।” অন্য দিকে, শুভাশিস চৌধুরী (বিজেপি-র জেলা সহ-সভাপতি) বলেন, “শতাব্দী রায় সাংসদ হিসাবে ব্যর্থ। মানুষ এ বার তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।”
তবে নাম ঘোষণার পরেই অনুপম হাজরাকে নিয়ে দলের বোলপুর কার্যালয়ে একটি সাংবাদিক বৈঠক করেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী। বৈঠকের পরে হতাশ নরেশবাবু নিজের মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখেন। তবে দুপুরে নরেশবাবু ফোনে বলেছিলেন, “আশা করেছিলাম টিকিট পাব। কিন্তু প্রার্থী ঘোষণার পর হতাশ হয়েছি। আমার কারও সঙ্গে দেখা করতে ভাল লাগছে না। আমাকে একান্তে থাকতে দিন।” আর অনুব্রতবাবু নিজে কী বলছেন? বলেন, “শতাব্দীদেবী বীরভূম কেন্দ্রে উন্নয়ন করেছেন। আবার মা মাটি মানুষের পাশে দাঁডাতে, উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ অব্যাহত রাখতে তাঁকেই প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছেন।” অনুপম হাজরা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বোলপুরের ভূমিপুত্র বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্র এবং বর্তমানে ওখানে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। তাই যুব প্রজন্মকে আরও বেশি সুযোগ করিয়ে দিতে এবং উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করতে দিদি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।” নরেশবাবু প্রসঙ্গে অবশ্য বলেন, দিদির সিদ্ধান্ত, শেষ সিদ্ধান্ত।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy