(বাঁ দিক থেকে) হামলার চিহ্ন। সভাপতির অফিসের মেঝেতে পড়ে রক্ত। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আহত কর্মাধ্যক্ষ সুচাঁদ দাস। তাণ্ডবের সাক্ষী এই আলোচনা কক্ষও। ছবি: শুভ্র মিত্র।
শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মারাত্মক চেহারা দেখল বাঁকুড়ার পাত্রসায়র।
এত দিন রাস্তায় মারপিট হচ্ছিল তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। এ বার পাত্রসায়র ব্লক অফিসের সভাকক্ষেই তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ বাধল। বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই সংঘর্ষের জেরে ব্লক অফিসে কার্যত তাণ্ডব চালাল তৃণমূলের লোকজন। বেধড়ক মার খেলেন পাত্রসায়র পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, দুই কর্মাধ্যক্ষ-সহ কয়েক জন। এক কর্মাধ্যক্ষ-সহ পঞ্চায়েত সমিতির দুই মহিলা সদস্যের শ্লীলতাহানির অভিযোগও উঠেছে অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্লক অফিসে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ঘটনার প্রতিবাদে তৃণমূলের এক গোষ্ঠী ব্লক অফিসের সামনে রাস্তা অবরোধ করে।
বাঁকুড়ার এই অঞ্চলে শাসকদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নতুন নয়। লোকসভা ভোটের পর থেকে তা চরম আকার নিয়েছে। পাত্রসায়র ব্লক তৃণমূল সভাপতি স্নেহেশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আর এক নেতা নব পালের গোষ্ঠীর বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে। একাধিক এলাকায় তৃণমূলের পার্টি অফিসে ভাঙচুর হয়েছে। বারবার মারপিট হয়েছে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। সব মিলিয়ে পাত্রসায়রের স্বাভাবিক জনজীবনেও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে তৃণমূলের এই দ্বন্দ্ব। পাত্রসায়র সদরে আবার স্নেহেশবাবুর গোষ্ঠীর সঙ্গে বিরোধ রয়েছে একদা ব্লক সভাপতিরই ঘনিষ্ঠ নেতা গোপে দত্ত, বাবলু সিংহদের। এই দু’জনই বর্তমানে নব পালের শিবিরের। পঞ্চায়েত সমিতি এবং ব্লকের ৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতে ক্ষমতাসীন স্নেহেশ-গোষ্ঠী। অন্য চারটি নব-গোষ্ঠীর দখলে। তৃণমূল সূত্রেই জানা যাচ্ছে, পঞ্চায়েত সমিতির কর্তৃত্ব নিয়ে দলের ওই দুই গোষ্ঠীর কাজিয়া এখন প্রকাশ্যে চলে এসেছে। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েক বার দুই গোষ্ঠীর লোকজনের মধ্যে নানা অছিলায় মারপিট, পার্টি অফিস ভাঙচুরের অভিযোগ হয়েছে।
এ দিনের ঘটনা সেই বিরোধেরই পরিণাম। প্রশাসন সূত্রের খবর, এ দিন পাত্রসায়র ব্লক সংসদের বার্ষিক সভা ছিল। পঞ্চায়েত সমিতির নতুন ভবনের দোতলায় সভা চলছিল। ওই সভায় বিডিও, সমিতির সভাপতি, সহ-সভাপতি, কর্মাধ্যক্ষ, ১০টি পঞ্চায়েতের প্রধান, উপপ্রধান এবং পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েতের সব সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষ হওয়ার পরেই গণ্ডগোল শুরু হয়। সভাস্থলের মধ্যেই বিডিও, সভাপতি-র সামনের চেয়ার, টেবিল উল্টে দিয়ে দুই গোষ্ঠী ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়ে। ঘটনার রেশ আছড়ে পড়ে ব্লক অফিসের সামনে। বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসে গোপে দত্ত সভাপতির চেম্বারে ঢুকে ভাঙচুর, তাণ্ডব চালান বলে অভিযোগ। চেম্বারের মধ্যেই মার খেয়ে জ্ঞান হারান পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ সুচাঁদ দাসের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়।
এ দিন দুপুরে ব্লক অফিসে গিয়ে দেখা গেল, সমিতির নতুন অফিসের দোতলা লন্ডভন্ড। চেয়ার-টেবিল ভেঙে তছনছ। সভাপতির চেম্বারে ভাঙা চেয়ার-টেবিল পড়ে। আর মেঝেয় রক্ত। ব্লক অফিস চত্বরে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। বিডিও অপূর্বকুমার বিশ্বাস দোতলার চেম্বারে বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে রয়েছেন। তৃণমূল নেতা বাবলু সিংহ (পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যও বটে), গোপে দত্ত-সহ কয়েক জন বিডিও-র সামনে বসে রয়েছেন। বিডিও-র কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে হাতের ইশারায় এ ব্যাপারে কিছু বলবেন না বলে তিনি জানিয়ে দেন। দুপুর তিনটে নাগাদ পাত্রসায়র ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, শয্যায় শুয়ে রয়েছেন সমিতির সভাপতি দিলীপবাবু, পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ সুচাঁদবাবু, শিশু ও নারী কল্যাণ কর্মাধ্যক্ষ সুনীতি মুখোপাধ্যায়। সুচাঁদবাবুর মাথায় ব্যান্ডেজ।
দিলীপবাবুর অভিযোগ, এ দিন দুপুর পৌনে একটা নাগাদ সভাশেষ হয়। তাঁরা বাইরে বেরনোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হঠাৎ বাবলু, অপর্ণা গোস্বামী, জুলফিকার আলি ভুট্টো, বেলুট-রসুলপুর পঞ্চায়েতের সদস্য তাপস বাড়ি-সহ কয়েক জন চেয়ার-টেবিল উল্টে ভাঙচুর শুরু করেন। দিলীপবাবু বলেন, “আমাদের এক মহিলা কর্মাধ্যক্ষের শ্লীলতাহানি করে আমাদেরকে মারধর করে ওরা। বিডিও-কেও চড় মারা হয়।” পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ সুচাঁদবাবুর অভিযোগ, “দোতলা থেকে নেমে সভাপতির চেম্বারে ঢুকে বাবলু, তার ভাই স্বপন, গোপে বহিরাগত দুষ্কৃতীদের নিয়ে এসে প্রথমে ভাঙচুর চালায়। আমার মাথায় লোহার রডের বাড়ি মারে। দিলীপদা আর সুনীতি মুখোপাধ্যায়কে যথেচ্ছ চড়-ঘুষি মারতে মারতে চেম্বারের বাইরে নিয়ে যায়। আমার ম্যানিব্যাগও কেড়ে নেয় ওরা।”
সুচাঁদবাবুর আক্ষেপ, “সিপিএমের রাজত্বে আমি দু-দু’বার পঞ্চায়েতের সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। কিন্তু, কোনও দিন আক্রান্ত হয়নি। আর আমাদের শাসনে দলেরই তোলাবাজরা এসে পঞ্চায়েত সমিতির অফিসে ঢুকে এমন বেনজির তাণ্ডব ঘটাবে, ভাবতে পারছি না।” খবর পেয়ে থানা থেকে পুলিশ গিয়ে লাঠি উঁচিয়ে বহিরাগতদের হটিয়ে দেয়। পুলিশের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে মার খান গোপে-গোষ্ঠীর পঞ্চায়েত সদস্য তাপস বাড়ি।
অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা বাবলু ও গোপে অবশ্য সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে পাল্টা দাবি করেন, সভার মধ্যে তাঁদের কোনও আলোচনা করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। বিডিও-কে সেটা বলতেই সভাপতি-সহ কয়েক জন তাঁদের দিকে তেড়ে গিয়ে মারতে শুরু করে দেন। তাঁদের গোষ্ঠীর পঞ্চায়েত সমিতির এক সদস্যার শ্লীলতাহানি করা হয় বলেও গোপের অভিযোগ। তিনি বলেন, “আমরা কাউকে মারধর করিনি।”
জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের ভূমিকাতেও ক্ষোভ বাড়ছে পাত্রসায়রের দলীয় কর্মী-সমর্থকদের একাংশের মধ্যে। তাঁদের বক্তব্য, পাত্রসায়রে এত দিন ধরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চললে তাতে লাগাম পরাতে সক্রিয় হননি জেলা নেতারা। এখন তাই পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। ব্লক তৃণমূল সভাপতি স্নেহেশবাবুর ক্ষোভ, “দলেরই কিছু লোক এ দিন ব্লক অফিসে ঢুকে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে, তাতে সবার মুখ পুড়ল! অথচ জেলা নেতৃত্ব এতবড় ঘটনার পরে কোন ব্যবস্থা নেয়নি।”
দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের প্রসঙ্গটি অবশ্য এড়িয়ে গিয়েছেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী। তাঁর বক্তব্য, “এটা আমাদের দলের কারও কাজ না দুষ্কৃতীদের, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। বিডিও-কে বলেছি পুলিশে অভিযোগ দায়ের করতে। দোষীদের গ্রেফতার করার জন্য পুলিশকে বলা হয়েছে।” যদিও ব্লক অফিস চত্বরে এত বড় ঘটনার পরেও বিডিও থানায় অভিযোগ না করায় তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দা এবং তৃণমূল নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশ। বিডিও ফোন ধরেননি। এসএসএসেরও জবাবও দেননি। জেলাশাসক বিজয়ভারতী বলেন, “প্রাথমিক ভাবে বিডিও জানিয়েছেন, তাঁর সামনে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলেও তাঁকে কেউ মারধর করেনি। আগামী দিনে এমনয়া যাতে না ঘটে, সে জন্য পুলিশকে বলা হচ্ছে।”
বৃহস্পতিবার রাতে যুযুধান দু’পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে। পুলিশ অবশ্য কাউকে ধরেনি। তবে, জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, পাত্রসায়র ব্লক অফিসে সিসিটিভি লাগানো আছে। বিডিও-র কাছে এ দিনের ঘটনার ফুটেজ চাওয়া হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy