হারেও হাসি। গণনাকেন্দ্রের বাইরে সুভাষ সরকার। ছবি: অভিজিত্ সিংহ।
নিজেদের ভোট ব্যাঙ্ক অক্ষত রেখে আরও ভোট বাড়িয়ে নিল তৃণমূল। উল্টে বামফ্রন্টের হাওয়া নিজেদের পালে কেড়ে নিয়ে বিজেপি-র নৌকা তরতরিয়ে অনেকটা এগিয়ে গেল। এক নজরে বাঁকুড়া কেন্দ্রের ফল এটাই।
সিপিএমের টানা ন’বারের সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া কার্যত এ কারণেই (সাড়ে ৯৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে) হেরে গেলেন বাঁকুড়া কেন্দ্রে। আর হারলেন তৃণমূলের সেই প্রার্থী শ্রীমতী দেব বর্মা ওরফে মুনমুন সেনের কাছে, রাজনীতির আঙিনায় যিনি একেবারেই আনকোরা (মুনমুনের ভোট প্রাপ্তি: ৪ লক্ষ ৮৩ হাজার ৪৫৫টি)।
গতবার বাসুবাবু ১ লক্ষ ৭ হাজার ৮০২টি ভোটে রাজ্য রাজনীতির অতি পরিচিত ডানপন্থী নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে (বর্তমানে রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী) হারিয়েছিলেন। এ বারও প্রচারের শুরুতে বাসুবাবু রসিকতা করে বলছিলেন, “আমার বিরুদ্ধে যাঁরা ভোটে দাঁড়িয়েছেন, পরের বার তাঁদের আর দেখা যায়নি।” তবে এ বার যে অন্যরকম হাওয়া বইছে তা আগাম আঁচ করেছিলেন বর্ষীয়ান এই বাম নেতা। শুক্রবার মিলেও গেল তা। বাসুবাবু ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ৯৪৯টি ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেন।
দিনের শুরুটা অবশ্য অন্যরকম ছিল। প্রথমে ঘোষণা করা হয়, তালড্যাংরা ও রানিবাঁধ বিধানসভা কেন্দ্রের কিছু এলাকায় বাসুবাবু কয়েক হাজার ভোটে এগিয়ে। কিছু পরেই ঘোষণা ভেসে আসে, বাসুবাবুর নিজের তালুক রঘুনাথপুর বিধানসভা এলাকায় এগিয়ে বিজেপি প্রার্থী সুভাষ সরকার। বাঁকুড়ার আরও কয়েকটি বিধানসভা এলাকার ভোট গণনা শুরু হওয়ার পরে হিসেব পাল্টাতে শুরু করে। সামগ্রিক ভাবে এগিয়ে আসে মুনমুনের নাম। শুধু তালড্যাংরা ও রানিবাঁধ বিধানসভা এলাকায় সপ্তম রাউন্ড পর্যন্ত এগিয়ে থাকেন বাসুবাবু।
কিন্তু রোদ যত চড়েছে, ততই পাল্লা ভারী হয়েছে তৃণমূলের। ফিকে হয়েছে খ্রিস্টান কলেজের গণনাকেন্দ্রের বাইরে সিপিএমের শিবিরের ভিড়। উল্টো দিকে তৃণমূলের শিবির ছিল প্রথম থেকেই কর্মী-সমর্থকদের ভিড়ে ঠাসা। সেখানে বড় এলইডি টিভিতে ভোটের ফলের দিকে নজর রাখছিলেন কর্মীরা। একের পর এক রাউন্ড যত এগিয়েছে, ততই ব্যবধান বাড়িয়েছেন মুনমুন। আর তৃণমূল কর্মীরা ততই আবির উড়িয়ে, বাজি-পটকা ফাটিয়েছেন কর্মীরা। কিছু অতুত্সাহী তৃণমূল কর্মী বেলা ১২টায় সিপিএমের শিবিরে থাকা লোকেদের দিকে তেড়ে গিয়ে পটকা ফাটায়। পুলিশ তা বেশিদূর গড়াতে দেয়নি। পৌনে ১টা নাগাদ বিজেপি প্রার্থী সুভাষ সরকার গণনাকেন্দ্রের বাইরে এলে তৃণমূলের কিছু কর্মী কটূক্তি করেন। পুলিশ প্রহরায় তিনি গণনাকেন্দ্রে ঢুকে যান।
সুভাষবাবুর প্রচারে এতদিন কর্মী-সমর্থকদের ভিড় দেখা গেলেও এ দিন গণনাকেন্দ্রের কাছে গেরুয়া কাপড়ে মোড়া বিজেপি-র শিবিরে অবশ্য লোকজন তেমন দেখা যায়নি। যদিও বিজেপি-র ভোট প্রাপ্তি (সুভাষবাবু ভোট পেয়েছেন ২ লক্ষ ৫১ হাজার ১৮৩টি) বুঝিয়ে দিয়েছে গতবারের (বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ গতবার এই কেন্দ্রে পেয়েছিলেন ৪২ হাজার ৬৬০ ভোট) তুলনায় এ বার প্রায় ছ’গুণ বেশি ভোট এসেছে তাদের ঝুলিতে। আর তাতেই যাত্রাভঙ্গ বাম প্রার্থীর।
দেশ জুড়ে বয়ে চলা মোদী-হাওয়ায় জেলার পরিচিত চিকিত্সক সুভাষবাবুকে বিজেপি প্রার্থী করায় ওরা এ বার বেশি ভোট টানবে বলে আগেই স্বীকার করেছিলেন তৃণমূল ও সিপিএম নেতৃত্ব। কিন্তু, বামফ্রন্টের ভোটাররা ইভিএমে যে বিজেপি-র বোতাম টিপবেন তা ভাবতেও পারেননি সিপিএমের পোড়খাওয়া নেতারাও। দলের জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্র বলেছিলেন, “বিজেপি বামেদের ভোট কিছুটা পেলেও বেশি ভোট কাটবে তৃণমূলের।” কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গিয়েছে, তৃণমূলের ভোট ঢের বেড়েছে (গতবার জোট প্রার্থী সুব্রতবাবু পেয়েছিলেন ৩,৬১,৪২১টি ভোট)। উল্টে ভোট কমেছে বামেদের (গতবার বাসুদেববাবু পেয়েছিলেন ৪,৬৯,২২৩টি ভোট)।
কেন এমন হল? সিপিএমের জেলা নেতৃত্বের একাংশের মতে, দলের সাংগঠনিক শক্তি কমেছে, বিরোধিতা করে লড়াইয়ের মানসিকতাও হারিয়েছে। তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে বাম সমর্থকদের কাছে তাই বিজেপি-ই এগিয়ে এসেছে। প্রথমবার ভোট ময়দানে নেমে সুভাষবাবুর অভিজ্ঞতা, “আমি এর থেকে বেশি ভোটই আশা করেছিলাম। সন্ত্রাস সত্ত্বেও যথেষ্ট লড়াই দেওয়া গিয়েছে। ভোটারদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।”
তিনি সারা দিনই গণনাকেন্দ্রে ছিলেন। কিন্তু বাসুদেববাবু স্কুলডাঙায় সিপিএমের জেলা অফিস থেকে আর বের হননি। তৃণমূলের কর্মীরা সেলিব্রিটি প্রার্থীকে কাছে না পাওয়ায় সকাল থেকেই হাহুতাশ করছিলেন। দুপুর পর্যন্ত গণনাকেন্দ্র থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে হোটেলের ঘরে টিভিতে নজর রাখছিলেন। রোদ কিছুটা মরতে বিকেল ৫টা নাগাদ হুড খোলা গাড়িতে মুনমুনকে স্বামী ভরত দেব বর্মার সঙ্গে হাত নাড়তে নাড়তে গণনাকেন্দ্রে আসতে দেখা যায়। তিনি ঘোষণা করেন, “এই জয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়। আমি বাঁকুড়ার জন্য কাজ করব।”
কর্মী-সমর্থকদের রোদ-ক্লান্ত মুখে ছড়িয়ে পড়ে স্বস্তির হাসি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy