সিউড়ি ১ ব্লকের চাঙ্গুরিয়া গ্রামের মাঠে গাঁদা ফুল সংগ্রহ করছেন চাষি পরিবারের এক মহিলা।
হাতে মাত্র এক থেকে দু’বিঘা জমি। এত স্বল্প জমিতে ধান চাষ করে খুব একটা লাভ হবে না। বহু বছর আগেই সেটা বুঝে গিয়েছিলেন ওঁরা। তার পরেই ফুল চাষের মতো বিকল্প চাষে ঝুঁকেছেন সিউড়ি ১ ও ২ ব্লকের বেশ কয়েক ঘর চাষি পরিবার। ফুল চাষ বলতে মূলত গাঁদা ফুলের চাষ। আর তাতেই লাভের মুখ দেখছেন ওঁরা। বর্তমানে সিউড়ি শহরের বিভিন্ন নার্সারি থেকে যে পরিমান গাঁদা ফুল বিক্রি হয় সেই ফুলের একটা বড় অংশের চাহিদা মেটাচ্ছেন সিউড়ি ঘেঁষা ওই চাষিরাই। ফুলের চাষটা মূলত করেন সিউড়ি ২ ব্লকের কেন্দুয়া পঞ্চায়েতের হাটজনবাজার কলোনি ও সিউড়ি ১ ব্লকের চাঙ্গুরিয়া বাগানপাড়ার অন্তত ২০ ঘর চাষি।
বছর কুড়ি আগে থেকেই ভাবনাটা শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে এ রাজ্যে আসা কেন্দুয়া পঞ্চায়েত এলাকার সিউড়ি ২ ব্লকের হাটজনবাজার কলোনির কয়েক ঘর চাষিরাই এই চাষ শুরু করেন। সেচখাল ‘কালী’ কাঁদর ঘেঁষা ফতেপুর মৌজায় থাকা জমিতে ফুল চাষের ভাবনা এসেছিল কয়েকজনের মাথায়। তাঁদেরই একজন কেনারাম সরকার বলছেন, “বছরে একবার ধান কিংবা গম, সর্ষের মতো প্রথাগত চাষ করে সংসার চালানো সম্ভব নয়। এই বাস্তবটা অনেক দিন আগেই বুঝে গিয়েছিলাম। তারপরই গাঁদা ফুল চাষ শুরু করি। আমার দু’বিঘা জমিতে পালা করে সারা বছর ধরে গাঁদা ফুলের চাষ হয়।” একই ভাবে ফুলের চাষ করেন পড়শি সুপ্রিয় মণ্ডলও।
সিউড়ি ২ ব্লকের এই অংশে যখন ফুল চাষে লাভের মুখ দেখছেন চাষিরা, দেখাদেখি চাঙ্গুরিয়ায় বসবাসকারি কয়েকঘর চাষিও ফুল চাষ শুরু করেন। তাঁদের মধ্যে বিভূতি মজুমদার, শিশুকুমার বল্লভ বা রণজিত্ সরকাররা কেউ ১০ বছর কেউ বা ১২ বছর ধরে ফুল চাষ করছেন। যা এলাকায় ব্যতিক্রমীও বটে। বিভূতিবাবুরা জনাচ্ছেন, হাতে থাকা জমি থেকে তিন ভাগে ভাগ করে নিয়ে গাঁদা ফুলের চাষ করতে হয়। শীতের সময় বীজ থেকে চারা ও বছরের অন্য সময় কলমচারার উপর নির্ভর করেই ফুল চাষটা হয়ে থাকে। একটা জমিতে যখন ফুল ধরেছে, তখন বীজ বা কলম থেকে চারা তৈরির প্রস্তুতি চলে অন্য জমিতে। মাটি তৈরি, জমিতে জৈব সার, অনুখাদ্য, ভিটামিন, কীটনাশক দেওয়া ছাড়াও প্রয়োজনীয় সেচ, যথেষ্ট পরিচর্যার প্রয়োজন। বীজ থকে চারা আনতে হলে মেদিনীপুর ও কলমচারা বা কাটিং চারা আনতে হলে উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ থেকেই তা নিয়ে আসেন বলে চাষিরা জানিয়েছেন।
কেমন লাভ হয়? কেনারামবাবু, সুপ্রিয়াবাবু, শিশু বল্লভরা বলছেন, “এক বিঘাতে সব কিছু নিয়ে যদি ৮ হাজার টাকা খরচ হয়। তিন মাসের মধ্যে ১৬ হাজার টাকা রোজগার হতে পারে। মরসুম অর্থাত্ বিশ্বকর্মা পুজো থেকে সরস্বতী পুজো পর্যন্ত লাভের পরিমান কিছুটা বেশি। তবে সিউড়ি শহরের বজারে দর ওঠানামা তেমন করে না। বাড়ির পুরুষ-মহিলারা সকলেই ফুল সংগ্রহ করেন।” যেহেতু মালা বা চেনে গেঁথেই ফুল বিক্রি হয় সে কাজে হাত লাগান বাড়ির মহিলারাও। সুপ্রিয়া সরকার, সীমা মণ্ডল, মালা মণ্ডলদের কথায়, “হাতে হাতেই সেই কাজ আমরা করে থাকি। বাড়ির পুরুষেরা শহরের বাজারে সেগুলি দিয়ে আসেন।” ফুল চাষিরা বলছেন ধান বা প্রথাগত চাষেও যথেষ্ট খাটতে হয়। তবে ফুল চাষে শুধু লাভ বেশি তাই নয়, কাঁচা পয়সাও সহজেই মেলে। সিউড়ি বাজারে নার্সারি রয়েছে বা ফুলের ব্যবসা করেন গৌতম দাস, স্বাধীন দত্তদের মতো আরও অনেকে। তাঁরা বলছেন, “গাঁদা ফুলের চাহিদা ভালই। এখনও বাইরে থেকে ফুল আনাতে হয়। কিন্তু একটা সময় সমস্ত গাঁদা ফুল যা বাইরে থেকে আসত সেটার একটা বড় অংশই সরবরাহ করেন স্থানীয় ফুল চাষিরা। প্রথমত কাছে হয়। দ্বিতীয়ত টাটকা ফুল পাই।”
প্রথাগত চাষ ছেড়ে বিকল্প চাষে মন দেওয়াকে সাধুবাদ জানিয়েছেন জেলা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যান পালন আধিকারিক সুবিমল মণ্ডল। তিনি বলছেন, “যথেষ্ট ভাল উদ্যোগ। ফুল চাষে পরিশ্রম ও লাভ দুটোই বেশি। আমাদের দফতর ফুল চাষে কিছু চাষিকে সাহায্যও করেছে। মূলত ময়ূরাক্ষী সেচখালের দু’দিকের জমিতেই কিছু চাষি ফুল চাষ করেন। কারণ ফুলচাষে বড় শর্ত সেচ। সেচখাল থাকায় সুবিধা হয়।”
ছবি তুলেছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy