ছ’মাস ধরে তালা ঝুলছে বীরভূম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের ১৭টি শাখাতেই। নাভিশ্বাস উঠেছে ওই ব্যাঙ্কের উপরে নির্ভরশীল জেলার তিনশোরও বেশি সমবায় সমিতির। এরই মাঝে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল ভরানোর নয়া নির্দেশিকা আরও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে ইতিমধ্যেই সঙ্কটে থাকা সমবায় সমিতিগুলির একটা বড় অংশকে। বীরভূমে অন্তত এমনটাই অভিযোগ করছেন সমবায়গুলির ম্যানেজার থেকে গ্রাহকদের একাংশ। তাঁদের ক্ষোভ, মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে আগেও দান দিলেও এ ভাবে কখনও নির্দেশিকা জারি করা হয়নি। ওই নির্দেশিকার ‘চাপে’ই ধুঁকতে থাকা বহু সমবায় সমিতিকেও টাকা দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ।
সমবায় দফতরের জেলা সহকারী কো-অপারেটিভ রেজিস্টার সৌগত সেনগুপ্ত অবশ্য ওই অভিযোগ উড়িয়েই দিয়েছেন। তাঁর দাবি, “মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করার জন্য জেলায় সমবায় সমিতিগুলিকে কোনও রকম চাপ দেওয়া হয়নি। বরং এ জেলায় এমন সমবায় সমিতিও রয়েছে, যারা মাত্র ৫০০ টাকাও দান দিয়েছেন।” তাঁর যুক্তি, ‘চাপ’ থাকলে ওই সমিতিগুলি অল্প টাকা দানের সুযোগ পেত না।
প্রায় ৬২ কোটি টাকার ঋণ অনাদায়ী হয়ে যাওয়ায় গত ১৫ মে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বীরভূম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের ব্যাঙ্কের লাইসেন্স বাতিল করে। এরপর প্রায় সাত মাস ধরে ব্যাঙ্কের ১৭টি শাখার আমানতকারীরা উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন। সুদ তো দূরের কথা আসল পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে ধন্দে রয়েছেন তাঁরা। জেলার ৩৬ লক্ষ বাসিন্দার মধ্যে ১২ লক্ষ কোনও না কোনও ভাবে ব্যাঙ্কের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। ব্যাঙ্কের অধীনে থাকা ৩৩১টি সমবায়ের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন চাষি, তন্তুবায়, শিক্ষক ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যেরা। সবচেয়ে বেশি সমস্যা পড়েছেন তাঁরাই। চাষের কাজের জন্য বীজ থেকে সার, কোনও কিছুই পাচ্ছেন না। এমনকী, জমানো টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প, মিড-ডে মিল, বার্ধক্য-বিধবা-অক্ষম ভাতা, রাষ্ট্র্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনার মতো সরকারি প্রকল্পের টাকাও তুলতে পারছেন না।
ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকার পর থেকে জেলায় বিরোধী দলগুলি এবং আমানতকারীরা বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভ দেখিয়ে সরকারের উপরে চাপ বাড়িয়েছেন। সম্প্রতি সমবায় বিষয়ক মন্ত্রিগোষ্ঠী ৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে ব্যাঙ্ক খোলার বিষয়ে নীতিগত ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ছ’ সপ্তাহ পেরিয়েও অর্থ দফতর থেকে ছাড়পত্র মেলেনি। ফলে সাত মাসেও ব্যাঙ্কের ভবিষ্যত্ নিয়ে ধোঁয়াশা কাটল না। প্রায় দু’লক্ষ ৬৫ হাজার আমানতকারীর প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার ভবিষ্যত্ এখনও অনিশ্চিত। এই পরিস্থিতির মধ্যেই গত ৩১ অক্টোবর রেজিস্টার অফ কো-অপারেটিভ সোসাইটি থেকে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করার জন্য এই নয়া নির্দেশ!
এ দিকে, শুক্রবার থেকেই শুরু হয়েছে ৬১তম নিখিল ভারত সমবায় সপ্তাহ। সমবায় দফতরের জারি করা নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, সমবায় সপ্তাহের অনুষ্ঠানে ত্রাণ তহবিলের জন্য টাকা দিতে হবে। যে সব সমিতি মোটা টাকা দান করবে, তাদের জন্য ইনামেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। কী সেই ইনাম? লক্ষাধিক টাকা ত্রাণ তহবিলে দিলে সংশ্লিষ্ট সমবায় সমিতির অনুষ্ঠানে কর্তাদের বিশেষ অতিথির মর্যাদা দেওয়া হবে। বসার সুযোগ মিলবে প্রথম সারিতে। বীরভূম রেঞ্জের সহকারী কো-অপারেটিভ রেজিস্টার ওই নির্দেশ কার্যকর করার জন্য জেলার সমস্ত ব্লকের সমবায় পরিদর্শকদের নির্দেশ দিয়েছেন। এ দিকে দীর্ঘ ছ’মাস ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকায় সমবায় পরিদর্শকরা নিজ নিজ ব্লকে সমিতিগুলির কাছে ত্রাণ তুলতে গিয়ে রীতিমতো সমস্যায় পড়েছেন। অভিযোগ, অধিকাংশ সমিতিই ক্ষোভের সঙ্গে তাঁদের কাছে প্রশ্ন তুলেছেন, দুর্দশার মধ্যেও কেন এই ত্রাণ তহবিলের চাপ?
দফতর সূত্রের খবর, বীরভূম জেলা থেকে ছ’ লক্ষ টাকা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে তুলে দেওয়া হবে। ওই পরিমাণ টাকা দিতে গিয়েও এই জেলার সমবায় সমিতিগুলির সঙ্কট আরও প্রকট হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। একাংশ মনে করছে, ত্রাণ তহবিলে দান করলে হয়তো মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুশি হয়ে ব্যাঙ্ক-জট কাটাতে উদ্যোগ নেবেন। তাই ‘অনিচ্ছা’ সত্ত্বেও ওই সব সমিতি এই আশাতেই সঙ্কটের মধ্যেও অনুদান দিতে রাজি হয়েছেন। বীরভূমের নলহাটি ১ ব্লকের সমবায় সমিতিগুলির কার্যকলাপ বরাবরই প্রশংসিত হয়ে আসে। ব্লকের ২৩টির মধ্যে ১৬টি সমিতিরই ওই ব্যাঙ্কে প্রায় ২৫ কোটি টাকা ডিপোজিট জমা আছে। ব্লকের সমবায় পরিদর্শক অনুপকুমার বসাক বলেন, “যেহেতু বীরভূম জেলার সমবায় ব্যবস্থায় নলহাটি ১ ব্লক অগ্রণী। তাই স্বাভাবিক কারণে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করার জন্য এখান থেকে ভাল সাড়া মেলার আশা রয়েছে। যারা দীর্ঘ দিন ধরে লাভ করে আসছে, ওই সমিতিকে এ নিয়ে আবেদন করেছি।” আবার মুরারই ১ এবং মুরারই ২ ব্লকের সমবায় পরিদর্শক মিলন চক্রবর্তী জানান, ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকার জন্য দু’টি ব্লকের সমিতিগুলি থেকে ন্যূনতম টাকাই ত্রাণ তহবিলে দেওয়া হয়েছে।
রাজ্য সরকারের ত্রাণ তহবিলে সমবায়গুলি অতীতেও দান করেছে। কিন্তু এ ভাবে নির্দেশিকা জারি করে দান করার নির্দেশ নজিরবিহীন বলেই তারা দাবি করছে। অন্য দিকে, সমিতিগুলির একাংশ অবশ্য আরও একটি কথা তুলছেন। ‘দানে’র ভিত্তিতে সরকারের কাছে ‘পুরস্কার’ মেলা নিয়ে তাঁরা যথেষ্ট আপত্তি তুলছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সমবায় সমিতির ম্যানেজারের বক্তব্য, “ত্রাণ তহবিলে দান কেন কোনও সমবায় সমিতির পুরস্কার পাওয়ার মাপদণ্ড হবে? এত প্রতিকূলতার মধ্যেও বছরভর যে সব সমিতি গোটা সমবায় ব্যবস্থার জন্য ভাল কাজ করে গেল, তারাই তো পুরস্কার পাওয়ার ব্যাপারে প্রথম পছন্দ হওয়া উচিত! তার বদলে দানের মাপদণ্ডে সরকারি ‘বদান্যতা’ দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু মঙ্গলজনক নয়।”
দফতরের কর্তারা অবশ্য এ নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy