সিউড়িতে সমবায় ব্যাঙ্কে লাইন আমানতকারীদের।
ব্যাঙ্কে এসে আমানতকারীরা তাঁদের গচ্ছিত টাকা তুলতে না পারলে যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে পারে, তার একটা ইঙ্গিত শনিবারই পেয়েছিলেন জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। সেই অসন্তেষের মাত্রা বেড়ে গেলে জেলাজুড়ে কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের কর্মী ও আধিকারিকেরা যাতে ক্ষোভ বা বিক্ষোভের মুখে না পড়েন সেটা নিশ্চিত করতে সবকটি ব্যাঙ্কেই পর্যাপ্ত পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা ছিল সোমবার।
প্রসঙ্গত, বিপুল অনাদায়ী ঋণ আদায় করতে সমর্থ না হওয়ায় শনিবার থেকেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশে হঠাৎ সমস্ত রকম লেনদেনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয় কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের প্রতিটি শাখায়। কবে থেকে ব্যাঙ্কের কাজ কর্ম স্বাভাবিক হবে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে শনিবার ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যন নুরুল ইসলাম বলেছিলেন, “এটি সরকারি ব্যাঙ্ক। এই অচলাবস্থা কাটানোর জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষে থেকে সব রকম ভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। এখানে আমানতকরারীদের টাকা সুরক্ষিতই রয়েছে। থাকবে। কেউ যেন দুশ্চিন্তা না করেন। দরকার শুধু ধৈর্য ধরার।” সোমবার অবশ্য নরুলবাবুর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে একই আশ্বাস দিয়ে ব্যাঙ্কের বর্তমান ডিরেক্টর তথা জেলা সভধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী বলেন, “সমস্যা সমাধনের পথ বের করতে নরুলবাবু কলকাতা গিয়েছেন। আশা করি দ্রুত কিছু একটা সমাধান সূত্র বেরোবে।”
দুবরাজপুরে পাহারায় ব্যাঙ্ক কর্তারা। —নিজস্ব চিত্র
কিন্তু নরুলবাবু বা বিকাশবাবুরা যতই আশ্বাস দিন আমনতকারীর একটা বড় অংশই এ ব্যাপারে আশঙ্কা যাচ্ছে না। সেটার প্রমাণ মিলল সোমবারই। সকাল থেকেই সিউড়ি মূল ব্যাঙ্ক বা দুবরাজপুর শাখায় দলে দলে ভিড় জমালেন তাঁরা। সকলেরই একটাই প্রশ্ন, গচ্ছিত টাকাটা জলে যাবে না তো? টাকা সুরক্ষিত থাকবে তা সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর ঘেরাটোপে থেকে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ও কর্মীরা যথা শান্তভাবে আমনতকরীদের বোঝাবার করেন। কোনও কোনও গ্রাহক আবার বলেছেন, “ভীষণ প্রয়োজন। তাই টাকা তুলতে এসছি। এখন টাকা না পেলে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আটকে যাবে।” সেই সব গ্রহককে বুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে ম্যানেজার, চেয়ারম্যান, সিইও-সহ আধিকারিকের নম্বর দিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে আগামী দিনে কী হচ্ছে তা জেনে নিতে অনুরোধ করেছেন। শুধু কী আমানতকারীরা ব্যাঙ্ক ডুবতে পারে এমন অজানা আশঙ্কায় সিউড়ির মূল শাখায় ভিড় জমিয়েছিলেন লকার ব্যবহারকারীরাও। তাঁরা অবশ্য লকার ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছেন। কিন্তু হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে আমানতকারীদের।
কিন্তু এমন সমস্যা হওয়ার কারণটা ঠিক কী? প্রায় ৬২ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ায় ২০০৭ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ব্যাঙ্কিং রেগুলেশন অ্যাক্ট ১১/১ আরোপ করে বীরভূম জেলার কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের সবকটি শাখায় ঋণদানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ম হল কোনও ঋণ তথা অনুৎপাদক সম্পদের (এনপিএ) পরিমাণ ৫ শতাংশের বেশি হওয়া চলবে না। কিন্তু বীরভূম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছিল তার ৫২ শতাংশ খেলাপি বা অনুৎপাদক সম্পদে পরিণত হয়। সে জন্যই এমন কড়া পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছিল। ব্যাঙ্কেরই একটি সূত্রের খবর, বহু বছর ধরে এমন সব গ্রাহককে ঋণ দেওয়া হয়েছিল যার অধিকাংশই আদায় হয়নি। ব্যাঙ্কিং আইনে এনপিএ হয়ে যাওয়া টাকার অঙ্কের পুরোটাই ক্ষতি হিসেবে দেখানো হয়। ২০০৭ সালের ৩১ মার্চ জমা পড়ার পর দেখা যায় এনপিএ হওয়া টাকার অঙ্ক ব্যাঙ্কের মোট সম্পত্তির একটা বড় অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতেই প্রথমে ঋণ দানে নিষেধাজ্ঞা এবং পরিস্থিতি না বদলানোয় পাঁচ বছর পর কোনও নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে না জানিয়ে দেয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক বা তার কোনও শাখা নতুন গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট খুলতে বা কোনও দায় তৈরি করতে পারবে না বলে শর্ত আরোপ করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। সমস্যার সূত্রপাত সেই তখন থেকেই।
তবে শনিবার নুরুলবাবু জানিয়েছিলেন, কী ভাবে আনাদায়ী ঋণের পরিমাণ মিটিয়ে দেওয়া যায় তা নিয়ে রাজ্য সমবায় মন্ত্রী, মৎস্য মন্ত্রী, সচিব ও ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে গত ফেব্রুয়ারি মাসে বৈঠক হয়েছে। তাতে ঠিক হয় ৪০ কোটি টাকা অর্থ দফতর থেকে দেওয়া হবে। সেই টাকা যখন মঞ্জুরির দোরগোড়ায় সেই সময় নির্বাচনের নির্ঘন্ট ঘোষণা হওয়ার সেই প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়েছে। নির্বাচন পর্ব চুকে যাওয়ার পর সেই টাকা আসার কথা। এর মধ্যেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশ এল। সোমবার একই দাবি করেছেন বিকাশবাবু। তিনি বলেন, “রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তো প্রতি বছর অডিট করে। ২০০৭ সালের অনেক আগেই তো সমস্যা ধরা পড়ার কথা ছিল। যদিও বা সমস্যা ধরা পড়ল তখন কেন আগে এই পদক্ষেপ নেয়নি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তা হলে এই সমস্যা তৈরি হত না। তবে সমাধন সূত্র বের হবেই। রাজ্য সরকার পাশে রয়েছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy