জল কম কংসাবতীর জলাধারে। আর তার জেরে চাষ মার খাওয়ার আশঙ্কায় কৃষকেরা। —নিজস্ব চিত্র
কানায় কানায় পূর্ণ জলাধার। জলাধারের গেট থেকে হু হু করে জল কংসাবতী নদীতে নামছে। টইটম্বুর জলাধার দেখতে ভরা শ্রাবণেই পর্যটকদের ঢল। কেচোন্দা ঘাটে কংসাবতীর নিচু কজওয়ের উপর দিয়ে জল বইছে।
ফি বছর অগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে রাজ্যের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র মুকুটমণিপুর জলাধারের এটাই চেনা ছবি। এ বার কিন্তু পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে সেই চেনা ছবি উধাও। অগস্টের প্রথম সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনও মুকুটমণিপুর জলাধার ভরে ওঠেনি। যা জল থাকার কথা, রয়েছে তার থেকে অনেক কম জল। ফলে জলাধারকে ঘিরে বর্ষায় যে পর্যটন ব্যবসা হয়, এ বার তাও মার খাচ্ছে। বিপাকে পড়েছেন নৌকা চালক থেকে মাছ ব্যবসায়ী সকলেই। জুলাই মাস পর্যন্ত পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়নি। ফলে সেচের জন্য কংসাবতীর সেচখালে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল না মিললে দক্ষিণ বাঁকুড়ার পাশাপাশি পশ্চিম মেদিনীপুর, হুগলি জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে এই জলাধারের জলের উপরে নির্ভরশীল চাষিদের মাথায় হাত পড়ে গিয়েছে। যদিও কংসাবতী সেচ দফতরের আধিকারিকরা এখনও আশাবাদী। তাঁদের আশা, অগস্ট মাসে পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলায় বৃষ্টির পরিমাণ একটু বাড়লেই জলাধার পূর্ণ হয়ে যাবে।
কংসাবতী সেচ দফতর সূত্রের খবর, মুকুটমণিপুর জলাধার থেকে খরিফ ও বোরো মরসুমে জল ছাড়া হয়। বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর ও হুগলি জেলার ৫ লক্ষ ৭০ হাজার একর জমিতে সেচের জল পৌঁছয়। বর্তমানে এই জলাধারে জলধারণ ক্ষমতা প্রায় ৪৪৫ ফুট (৩ লক্ষ ৭০ হাজার ৫০০ একর ফুট)। কংসাবতী সেচ দফতরের সুপারিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার (১) দেবাশিস মৌলিক বলেন, “এখন মুকুটমণিপুর জলাধারে জলস্তর ছিল ৪২০ ফুটের আশেপাশে রয়েছে (২ লক্ষ ৬০ হাজার ৮৫৪ একর ফুট)। গত বছর অগস্টের প্রথম সপ্তাহে এর থেকে প্রায় ১৫ ফুট জল বেশি ছিল।” তিনি জানান, পুরুলিয়ায় কুমারী ও কংসাবতীর ঊর্ধ্বমুখে জুলাই মাসে সে ভাবে ভারী বৃষ্টি হয়নি। ফলে, জলাধার এখনও ভরেনি। পর্যাপ্ত জল না থাকায় সেচের জন্য জল দেওয়ার ক্ষেত্রে এ বার সমস্যা হতে পারে। তবে অগস্ট মাসে ভারী বৃষ্টি হলেই জলাধার ভর্তি হয়ে যাবে বলে আশাবাদী দেবাশিসবাবু। সোমবার অবশ্য কংসাবতী জলাধার থেকে রাইট ক্যানালে ৫০০ এবং লেফট ক্যানেল ১০০০ কিউসেক হারে জল ছাড়া হয়েছে।
কুমারী ও কংসাবতী নদীর এই জলাধার দেখতে প্রায় সারা বছরই এখানে বহু দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন আসেন। বিশেষত অগস্ট মাস থেকেই ধীরে ধীরে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। পর্যটকদের ঢল থাকে শীতের শেষ পর্যন্ত। জলাধারের অন্য পাড়ে রয়েছে বন পুকুরিয়া ডিয়ার পার্ক। কিছুটা দূরে পরেশনাথ মন্দির। জলাধারে রয়েছে মোটরচালিত ও হস্তচালিত প্রায় ৫০টি নৌকা। আশেপাশের তেঁতুলচিটা, খড়িডুংরি, ভুটকুঘুটু, ভেলাইগোড়া, ভমরপুর-সহ বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দা জলাধারে নৌকা চালিয়ে সংসার চালান।
সম্প্রতি মুকুটমণিপুরে গিয়ে দেখা গেল, জলাধারে হাতেগোনা দু-চারটি নৌকা ভাসছে। কিন্তু পর্যটক নেই। নৌকাচালক জীবন মুদি, সুকেশ সিং পাতর বলেন, “গতবছর এই সময়ে জলাধার কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। বহু পর্যটক এখানে এসেছিলেন। আমরাও দুটি রোজগার করেছি। কিন্তু এ বার জলাধারে জল না থাকায় বেড়াতে কেউ আসছেন না। ফলে আমাদের রুজি রোজগার মার খাচ্ছে।” জলাধার লাগোয়া পাড়ের দোকানদারদের বক্তব্য, জল না থাকায় পর্যটকেরা গতবারের তুলনায় এ বার কম এসেছেন। বিক্রিবাটাও তেমন হচ্ছে না।
এই জলাধারে মাছ চাষের সঙ্গে যুক্ত এলাকার প্রায় ৫০০০ মানুষ। খাতড়া ব্লকের গোড়াবাড়ি, রানিবাঁধ ব্লকের পুড্ডি, অম্বিকানগর ও হিড়বাঁধ ব্লকের মশিয়াড়া পঞ্চায়েতের প্রায় ৩০টি গ্রামের বাসিন্দাদের নিয়ে সাতটি মৎস্য সমিতি তৈরি করা হয়েছে। জলাধারে মাছ ধরেই তাঁরা সংসার চালান। জলাধারে জল কম থাকায় মাছ চাষের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন মৎস্যচাষিরা। মশিয়াড়া ধীবর মৎস্য সমিতির সভাপতি বিমল ধীবর বলেন, “এলাকার বহু মানুষ মুকুটমণিপুর জলাধারে বৈধভাবে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। সময়ে বৃষ্টি না হওয়ায় মৎস্যজীবীরা আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।” এই জলাধারে মাছ ধরেই দিনযাপন করা পুড্ডি গ্রামের ললিত সর্দার, ঝাপানডিহি গ্রামের সুদেব দুলে। তাঁদের আক্ষেপ, “বৃষ্টির অভাবে চাষ মার খেয়েছে। জলাধারে জল না থাকায় মাছ ধরতে গিয়ে সারাদিন কেটে গেলেও সে ভাবে মাছ উঠছে না। আমাদের সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তাঁরা সবাই এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে। আকাশ পরিষ্কার হলে ওঁদের মুখ ভার, আকাশে মেঘ জমলেও ওঁদের চোখমুখে খুশির ঝিলিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy