Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

ক্লাস্টার ঘিরে লাক্ষার পুনরুজ্জীবনের স্বপ্ন

দিগন্ত এখন লালে লাল। পলাশ বনে এই বসন্তে যেন আগুন লেগেছে। পলাশ, কুসুম আর কুল ঘেরা বলরামপুরে এক সময় লাক্ষা শিল্পে দেশের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। লাক্ষা চাষের উপযোগী ওই গাছের প্রাচুর্য দেখে মির্জাপুর থেকে বলরামপুরে আসে জয়সওয়াল কোম্পানি। তারাই লাক্ষা চাষকে এখানে শিল্পে রূপান্তরিত করে। দক্ষ শ্রমিক নিয়ে আসা হয় মির্জাপুর থেকে। সে গত শতাব্দীর গোড়ার কথা। একে একে এই শিল্পে এলাকার মানুষজনও জড়িয়ে পড়েন।

রোদে শুকোনো হচ্ছে লাক্ষা। ছবি: সুজিত মাহাতো।

রোদে শুকোনো হচ্ছে লাক্ষা। ছবি: সুজিত মাহাতো।

প্রশান্ত পাল
বলরামপুর শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:০২
Share: Save:

দিগন্ত এখন লালে লাল। পলাশ বনে এই বসন্তে যেন আগুন লেগেছে। পলাশ, কুসুম আর কুল ঘেরা বলরামপুরে এক সময় লাক্ষা শিল্পে দেশের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।

লাক্ষা চাষের উপযোগী ওই গাছের প্রাচুর্য দেখে মির্জাপুর থেকে বলরামপুরে আসে জয়সওয়াল কোম্পানি। তারাই লাক্ষা চাষকে এখানে শিল্পে রূপান্তরিত করে। দক্ষ শ্রমিক নিয়ে আসা হয় মির্জাপুর থেকে। সে গত শতাব্দীর গোড়ার কথা। একে একে এই শিল্পে এলাকার মানুষজনও জড়িয়ে পড়েন। শ্রমিক হিসেবে অনেকে যেমন যুক্ত হন, তেমনই ব্যবসায়ীরাও এই শিল্পে নামেন। সব মিলিয়ে বলরামপুর সদর ও আশপাশের গ্রামে শতাধিক লাক্ষাকুঠি তৈরি হয়েছিল। কাজে যুক্ত ছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। এত মানুষের রুজি রোজগারের সঙ্গে এই শিল্প এমন ভাবে জড়িয়ে যে এখানকার ধর্মঘট থেকেই বলরামপুরে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। জেলায় কমিউনিস্ট পার্টির যাত্রাও শুরু হয়েছিল এই বলরামপুর থেকেই। ইতিহাস বলে, ১৯৪২-’৪৩ সালে বলরামপুরে লাক্ষাকুঠীর প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।

এখানকার লাক্ষার সুনামও ছিল। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকা তো বটেই, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ইতালি পর্যন্ত গালা যায়। ফলে বলরামপুরের অর্থনীতির উন্নয়নে এই লাক্ষা শিল্পের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে গত কয়েক বছরে এই শিল্পে মন্দা দেখা দিয়েছে। লাক্ষা থেকে এখানে মূলত গালা তৈরি করা হয়।সেই গালা প্রশাসনিক কাজে সিল দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া আসবাবপত্রে পালিশ করার কাজেও গালা লাগানো হয়। এবং বিশেষ অ্যাসিড তৈরিতে, ফল তাজা রাখতে, প্রসাধনী তৈরিতে ব্যবহার গালা ব্যবহার করা হয়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজার নেই। চাহিদা কমে গিয়েছে। দামও অর্ধেকের নীচে পড়ে গিয়েছে। সেই সঙ্গে কাঁচামালের অভাব। এক কথায় এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সামগ্রিক ভাবে সময়ের সঙ্গে তাল রেখে যে পরিবর্তন আনার দরকার ছিল, তা করা হয়নি বলে তাঁদের অনেকর মত। কয়েকজন ব্যবসায়ীরা জানান, লাক্ষা থেকে প্রস্তুত গালার ব্যবহার চিরাচরিত পথেই রয়ে গিয়েছে। কিন্তু গালা থেকে এখন অনেক রকম হস্তশিল্প তৈরি করা হচ্ছে। বিশেষত পুতুল, চুড়ি বা ঘর সাজানোর নানা সামগ্রী হচ্ছে। কিন্তু এখানে ওসব তৈরি করা হয় না। তেমন প্রশিক্ষণেরও এখানে ব্যবস্থা নেই। তার উপর ইদানীং ঝাড়খণ্ড, ওড়িশার ব্যবসায়ীরাও বাজারে ঢুকে পড়েছে। ফলে চিরাচরিত গালা তৈরি করে এখন বাজার ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এখনও বাইরে বলরামপুর, ঝালদা, তুলিনের গালার কদর রয়েছে।

সেই সুনামকে ধরে রেখেই জন্য সরকার গালা শিল্পে উন্নতির কিছু পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু সেই কাজ নিয়েও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে ধোঁয়াশা রয়েছে। এই শিল্পের উন্নয়নের জন্য ২০০৮ সালে রাজ্যের তত্‌কালীন ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প মন্ত্রী মানব মুখোপাধ্যায় বলরামপুরে লাক্ষা শিল্পকে কেন্দ্র করে ক্লাস্টার গড়ার কথা ঘোষণা করেন। লক্ষ ছিল, এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছোটবড় ব্যবসায়ীরা এক ছাদের তলায় প্রসেসিং ইউনিট গড়ে কাজ করবেন। কিন্তু ওই ঘোষণা দীর্ঘদিন ফাইলবন্দি হয়েই পড়েছিল। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের এই যৌথ প্রকল্পটি দিনের আলো দেখে রাজ্যের বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে। ২০১১-১২ সালে।

কী ভাবে প্রকল্পের রূপ দেওয়া যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে রাজ্য সরকার। তবে এলাকার লাক্ষা ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে বটে। কিন্তু প্রকল্পকে ঘিরে ঠিক কী হবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। আপাতত একটি কমিটি গড়ে তাঁরা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এই প্রকল্পে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার প্রকল্প ব্যয়ের ৯০ শতাংশ টাকা খরচ করবে। বাকি ১০ শতাংশ দিতে হবে উপভোক্তাদেরই। বলরামপুরের বিডিও সুচেতনা দাস জানান, পুরুলিয়া-জামশেদপুর জাতীয় সড়কের ধারে বলরামপুরে ঢোকার মুখেই ২.৬৪ একর জমি এই সমবায়কে লিজে দেওয়া হয়েছে। মোট সওয়া ছ’ কোটি টাকা প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে।

এক ছাদের তলায় লাক্ষা থেকে কী ভাবে বিভিন্ন শিল্প গড়ে তোলা হবে তা সরজমিনে দেখতে ইতিমধ্যে এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ীকে ঝাড়খণ্ডের নামকুমে কেন্দ্রীয় লাক্ষা রিসার্চ কেন্দ্র-সহ দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে আনা হয়েছে। যাঁরা ঘুরে এসেছেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বলেন, “ওখানে তো অনেক কিছুই দেখলাম। কিন্তু আমাদের এখানে কী করা হবে, তাই তো কেউ স্পষ্ট করে জানাচ্ছেন না।” অনেকে আবার, এই প্রকল্প থেকে সরেও দাঁড়িয়েছেন বলে জানিয়েছেন। প্রকল্পের ৯০ শতাংশ টাকা ধার নাকি অনুদান হিসেবে তাঁদের দেওয়া হচ্ছে তা নিয়েও অনেকে ধন্দে।

এক ব্যবসায়ীর কথায়, “এই প্রকল্পের রিপোর্টও এখনও তৈরি হয়নি বলে শুনেছি।” বিডিও-ও জানিয়েছেন, এই প্রকল্প সম্পর্কে তাঁদের কাছেও বিশদ খবর নেই। তিনি বলেন, “আমরা শুধু পরিকাঠামো গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করছি। এই প্রকল্পটি জেলা শিল্প দফতরই দেখছে।” তাঁর আশ্বাস, তবে প্রকল্পটি রূপায়ণের পথে অনেকটাই এগিয়েছে। এ নিয়ে জেলা শিল্প কেন্দ্রে বৈঠক ডাকা হয়েছে। পুরুলিয়া জেলা শিল্প কেন্দ্রের আধিকারিক প্রণব নস্কর বলেন, “গোড়ায় প্রকল্পের জমি জটে কিছুদিন দেরি হয়েছে। তবে জমি চিহ্নিত হয়ে গিয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি প্রকল্প রিপোর্টও পেয়ে যাব।” তিনি জানান, চলতি মাসেই লাক্ষার ক্লাস্টার বিষয়ে বলরামপুরে বৈঠক ডাকা হয়েছে।

এই ক্লাস্টার কি বলরামপুরের লাক্ষা শিল্পের সুদিন ফেরাবে? ব্যবসায়ীদের কথায়, বর্তমানে নানা সমস্যা ঘিরে ধরেছে এই শিল্পকে। প্রথমত কাঁচামাল অর্থাত্‌ লাক্ষার উত্‌পাদনই কমে গিয়েছে। যে জয়সওয়াল কোম্পানি মির্জাপুর থেকে বলরামপুরে এসে লাক্ষাকে শিল্পের মর্যাদা দিয়েছিল সেই পরিবারের উত্তরসূরী হরিশঙ্কর জয়সওয়ালের কথায়, “১৯০৮ সালে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা এখানে এসেছিলেন বলে শুনেছি। তখন লাক্ষার ভালো বাজার ছিল। কিন্তু এখন নানা সমস্যায় এই শিল্পে ভাটা চলছে। এই শিল্পকে নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।”

অন্য বিষয়গুলি:

amar shohor prashanta pal balarampur lac
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE