সামনেই উৎসবের মরসুম। তার আগে অন্ধকার আরও গাঢ় হল জেলায় বীরভূম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের প্রায় আড়াই লক্ষ গ্রাহকের জীবনে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করেছিল ওই ব্যাঙ্কের পরিচালন সমিতি। গত মঙ্গলবার বিচারপতি দেবাশিস করগুপ্ত সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। ফলে স্থগিতাদেশ পেলে দ্রুত ব্যাঙ্ক চালু হওয়ার যে আশা দেখা গিয়েছিল, সেই সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিণাশ হয়ে গেল। এই পরিস্থিতিতে ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত জেলার কয়েকশো সমবায় সমিতি ও কয়েক হাজার গ্রাহককে আপাতত তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে আগামী ২৬ নভেম্বরের দিকে। ওই দিনই এই মামলায় চূড়ান্ত রায় দেবে কলকাতা হাইকোর্ট। গত চার মাস ধরেই দ্রুত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দিচ্ছেন ব্যাঙ্কের পরিচালন কমিটির চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম। কিন্তু তার পরেও কিছু হচ্ছে না দেখে গ্রাহকদের একটা বড় অংশই হতাশ হয়ে পড়েছেন। হতাশা ধরা পড়েছে নুরুল ইসলামের কণ্ঠেও। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, “বৃহত্তর স্বার্থে হাইকোর্টে আবেদন করেছিলাম। আদালত তা না মানলে কী করব। আপাতত রায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছি।”
প্রসঙ্গত, বিপুল অনাদায়ী খেলাপি ঋণের জন্য গত ১৫ মে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ওই সমবায় ব্যাঙ্কের লাইসেন্স বাতিল করেছে। তার পর থেকেই জেলায় ব্যাঙ্কের ১৭টি শাখাতেই তালা ঝুলেছে। টাকা তুলতে না পেরে ব্যাঙ্কের আড়াই লক্ষেরও বেশি আমানতকারীরা দুর্ভোগে পড়েছেন। তাঁদের গচ্ছিত মোট ৩৫০ কোটি টাকার ভবিষ্যত কী, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সমস্যার আঁচ এসে পড়েছে ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত জেলার কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতিগুলিও। ব্যাঙ্কের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে না থাকলেও জেলার ৩৩১টি কৃষি উন্নয়ন সমিতির মধ্যে অন্তত ৯৫টি সমবায়ে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সেই সব সমিতির অধিকাংশেরই ৭০ শতাংশের বেশি অমানত কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের বিভিন্ন শাখায় গচ্ছিত রয়েছে। লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমানতকারীদের টাকাপয়সা ফেরানোর ক্ষেত্রে একই রকম সমস্যায় পড়েছে ওই সমবায় সমিতিগুলিও। কৃষিঋণ না পেয়ে সমস্যায় পড়েছেন জেলার অসংখ্য প্রান্তিক চাষি। এমনকী, লেনদেন বন্ধের জেরে উপভোক্তারা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের (১০০ দিনের কাজ, মিড-ডে মিল ইত্যাদি) টাকাও তুলতে পারছেন না বলে অভিযোগ।
নলহাটির কানিশাইল গ্রামের বাসিন্দা গদাধর মণ্ডল পেশায় চাষি। চাষের আয় থেকেই স্থানীয় বাউটিয়া সমবায় সমিতি এবং বীরভূম জেলা কেন্দ্রী। সমবায় ব্যাঙ্কের নলহাটি শাখায় টাকা জমা করতেন। কিন্তু গত চার মাস ধরে তাঁর কষ্ট করে ৫০ হাজার টাকা তুলতে পারছেন না। “সামনেই দুর্গাপুজো। কীভাবে কী করব, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম ছুটে গিয়েছে।” বলছেন গদাধরবাবু। শুধু গ্রাহকই নয়, সমস্যায় পড়েছেন ব্যাঙ্কের কর্মীরাও। মুরারই শাখার কর্মী, স্থানীয় ডুমুরগ্রামের বাসিন্দা মহম্মদ রবিউল আওয়াল প্রায় তিন বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পরে ওই ব্যাঙ্কের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর ক্ষোভ, “জমি জায়গা নেই। মা জটিল রোগে আক্রান্ত। তাঁর চিকিৎসা চলছে। বাড়িতে আরও চার বোন নিয়ে ছ’জনের সংসার টানতে হচ্ছে। চার মাস ধরে ব্যাঙ্ক বন্ধ। ধার দেনা করে সংসার চালাতেই দম বেরিয়ে যাচ্ছে। সামনে কুরবানিতে কী হবে, জানি না!” পাঁচ মাস বেতন বন্ধে একই ভাবে বাড়ির দুর্গাপুজোর আয়োজন নিয়ে মুশকিলে পড়েছেন ব্যাঙ্কের রামপুরহাট সান্ধ্য শাখার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার দেবাশিস মণ্ডলও। তিনি বলেন, “চার মাস ব্যাঙ্ক বন্ধ। বেতন পাচ্ছি না। ব্যাঙ্কে জমানো টাকাও তুলতে পারছি না। অথচ পারিবারিক প্রাচীন দুর্গাপুজো চালানোর ভার এ বার আমারই উপর পড়েছে। মায়ের পুজো চালাতে প্রায় এক লক্ষ টাকা খরচ হবে। কীভাবে সামাল দেব বুঝে উঠতে পারছি না।”
এমনিতে ওই ব্যাঙ্কে ৪৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে রাজ্য সরকারের। ব্যাঙ্কেরই কর্মী থেকে সমবায় সমিতির ম্যনেজারদের একটি বড় অংশের অভিযোগ, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশ অনুযায়ী লিকুইডেটর নিয়োগ করে ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সাড়ে তিনশো কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার দায় এড়াতে ব্যাঙ্কের পরিচালন সমিতিকে দিয়ে রাজ্য সরকারই মামলা তাঁদের ক্ষোভ, রাজ্য সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এত দিনে ব্যাঙ্কের জট খুলে যেত। সমবায় ব্যাঙ্কের উপর নির্ভরশীল জেলার লক্ষ লক্ষ বাসিন্দাকে এই উৎসবের মরসুমে অনিশ্চয়তায় দিন কাটাতে হত না।
ওই ব্যাঙ্ককে দেউলিয়া ঘোষণা করে রাজ্য সরকারকে গ্রাহকদের জমানো ৩৫০ কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। সে ক্ষেত্রে রাজ্যকে ব্যাঙ্কে একজন লিকুইডেটর নিয়োগ করতেও বলা হয়। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে এখনও কোনও পদক্ষেপ করেনি। উল্টে ব্যাঙ্কের পরিচালন সমিতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশের জন্য হাইকোর্টে মামলা দায়ের করে। বুজুং সমবায় সমিতির ম্যানেজার ডালিম পাল বলছেন, “আবার সারদার মতো একটি বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থার ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ালেও এখনও পর্যন্ত বীরভূমের এই সরকারি ব্যাঙ্কের গ্রাহকদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি সরকারকে। মাসখানেক আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বোলপুরে এলে এ নিয়ে কিছু করবেন বলে আশায় বুক বেঁধেছিলেন অনেকেই। কিন্তু সে দিন জেলার লক্ষাধিক মানুষের এই গভীর সঙ্কট নিয়ে একটি কথাও বলতে শোনা যায়নি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে।” এ নিয়ে নুরুল ইসলাম তখন দাবি করেন, বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন, তাই মুখ্যমন্ত্রী কিছু বলেননি। যা শুনে গ্রাহকদের পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, সারদা মামলাও তো আদালতে বিচারাধীন। তা হলে মুখ্যমন্ত্রী ৫০০ কোটির ক্ষতিপূরণ দেন কী করে?
এ দিকে, ব্যাঙ্ক খোলার দাবিতে শনিবারই কংগ্রেস রামপুরহাটে জাতীয় সড়ক অবরোধ করেছিল। ওই দিনই আবার ব্যাঙ্ক নিয়ে রাজ্যের টালবাহানার বিরুদ্ধে রামপুরহাটে রাজ্যের সমবায় মন্ত্রী জ্যোতির্ময় কর এবং প্রতিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অনুষ্ঠানে বিজেপি কর্মীরা কালো পতাকা দেখিয়েছেন। সেখানে বিজেপি ও তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায়। দৃশ্যতই বিব্রত হয়ে পড়েন রাজ্যের দুই মন্ত্রী। পুলিশের হস্তক্ষেপে অবশ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। পরে সমবায় মন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, মুখ্যমন্ত্রী বীরভূমের ওই ব্যাঙ্কটি বাঁচাতে তৎপর হয়েছেন। অর্থ দফতরও সচেষ্ট হয়েছে। শীঘ্রই ব্যাঙ্ক খুলে যাবে বলে তাঁর আশা। তবে, ঠিক কবে ব্যাঙ্ক খুলবে, তা তিনি জানাতে পারেননি। তিনি অবশ্য বলেন, “রিজার্ভ ব্যাঙ্ক লিকুইডেটর নিয়োগ করার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু আমরা তা না করেই ব্যাঙ্ক বাঁচাতে চাই। এতে ব্যাঙ্কের লক্ষ লক্ষ গ্রাহক বেঁচে যাবেন। এটা আগের সরকারের পাপ। আমরা হাত তুলে দিতেই পারতাম। কিন্তু আমরা তো তা করিনি। ” কিন্তু সারদার জন্য সরকার ৫০০ কোটি দিতে পারল, এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ৮০ কোটি টাকার অনুদান দিয়ে ব্যাঙ্ককে কেন বাঁচানো হচ্ছে না? মন্ত্রীর সাফ জবাব, “সারদা একটি আন্তঃরাজ্য বিষয়। কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক কেবল একটি জেলা ভিত্তিক বিষয়। একটি মাত্র জেলার ব্যাঙ্কের জন্য ৮০-৮৫ কোটি টাকা অনুদান দিতে হবে, এটা কি সরকারের পক্ষে কেন সম্ভব!”
সমবায় ব্যাঙ্কের বর্তমান সঙ্কটের জন্য মন্ত্রী সরাসরিই বাম আমলে ব্যাঙ্কের পরিচালন সমিতিকে দায়ী করেছেন। তাঁর অভিযোগ, “ব্যাঙ্কের পরিচালন সমিতির আগের চেয়ারম্যান ১৬-২০ বছর ধরে যাকে তাকে লোন দিয়েছে। এটা ক্রিমিনাল অফেন্স।” তাঁর বিরুদ্ধে কেন সরকার কোনও ব্যবস্থা নেয়নি তার সদুত্তর অবশ্য মন্ত্রীর কাছে নেই। অভিযোগ উড়িয়ে ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদক দীপক চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছেন, “আমাদের আমলে বেনিয়মে যুক্ত ম্যানেজারদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। এরা কী করেছে? বরং গত তিন বছরে ব্যাঙ্ককে আরও বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে।” দুই আমলের তরজায় ক্ষতিগ্রস্ত রবিউলরা কিন্তু বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে এই উৎসব না আসলেই ভাল হত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy