বিভিন্ন রকমের ডাল শস্য দিয়ে তৈরি হয়েছে খাতড়া স্টার ক্লাবের প্রতিমা।—নিজস্ব চিত্র।
থিম বৈচিত্রে এ বারও কালীপুজোয় মাতোয়ারা খাতড়া। হরেক রকমের থিমের ভিড়ে কালীপুজোয় যেন চাঁদের হাট বসেছে বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের এই মহকুমা সদরে।
পৌরাণিক যুগের কালীসাধক রামপ্রসাদের মাতৃভক্তির নমুনা থেকে সত্যজিত্ রায়ের হীরক রাজার দেশের মগজ ধোলাই কেন্দ্র কিংবা দক্ষিণ ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায় গন্ড জনজাতির জীবনশৈলী থেকে সমুদ্রমন্থনের দৃশ্যপট উঠে এসেছে এখানে। চোখ টানতে পারে চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙা মধুকরের এক ডিঙা ময়ূরপঙ্খী নৌকা থেকে অক্ষরধাম মন্দিরের দরজা। কোথাও আবার দক্ষিণেশ্বরের মন্দির, গ্রামবাংলার চালচিত্র ফুটে উঠেছে মণ্ডপে।
এ বারও খাতড়ায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৪০টির বেশি কালীপুজো হচ্ছে। গত বেশ কয়েক বছর ধরেই মণ্ডপ সজ্জায় সুনির্দিষ্ট ভাবনার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে কয়েকটি বড় পুজো কমিটি। থিমের সব কটি মণ্ডপই বেশ আকর্ষণীয়। তার মধ্যে এ বার নজর কাড়তে চলেছে মেধাবী সঙ্ঘ, স্টার ক্লাব, নাইন স্টার, গোল্ডেন সূর্য, নেতাজি রোড, সিনেমা রোড, রবীন্দ্র সরণি, রঙ্কিণী সঙ্ঘ, শ্রীপল্লি, পাম্পমোড় সর্বজনীনের মতো কয়েকটি মণ্ডপ। আলোকসজ্জাও দর্শণার্থীদের মন ভরাবে বলে আশাবাদী উদ্যোক্তারা।
অসুর ও দেবতাদের সমুদ্র মন্থনের ছবি ফুটে উঠেছে মেধাবী সঙ্ঘের মণ্ডপে। মেধাবী সঙ্ঘের সম্পাদক বিশ্বজিত্ চট্টোপাধ্যায় জানান, বিশাল এলাকা জুড়ে খড়, মাটি, বাঁশ, কাপড় দিয়ে এই মণ্ডপটি তৈরি করা হয়েছে। পুজো উপলক্ষ্যে এখানে মেলা বসছে। অভিনব মণ্ডপ তৈরি করে এবারও চমক দিতে চাইছে খাতড়া নাইন স্টার ক্লাব। শিল্পী বাপি সূত্রধর জানান, মরাঠি আদিবাসী জনজাতি গন্ড সম্প্রদায়ের সাজপোশাক থেকে উত্সব পালনের রীতিনীতি তুলে ধরা হচ্ছে মণ্ডপে। বাঁশ, থার্মোকল, মাটি, তালপাতা, খড়, কাপড় ও চট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই মণ্ডপ। পিছিয়ে নেই খাতড়া স্টার ক্লাব। দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের আদলে তৈরি সুউচ্চ মণ্ডপ তৈরি হয়েছে। তবে এই ক্লাবের প্রতিমা এ বার দর্শকদের যথেষ্ট নজর কাড়বে বলে দাবি করেছেন ক্লাবের সভাপতি গৌতম কুণ্ডু। তিনি জানান, কাঁথির শিল্পী জয়দেব বর মুগ, মুসুর, রমা কলাই দিয়ে রঙিন প্রতিমা তৈরি করেছেন। রাস্তার দু’ধারে থাকছে আলোকসজ্জা।
কালীসাধক রামপ্রসাদের কালীপ্রেমের খণ্ডচিত্র ফুটে উঠেছে খাতড়া নেতাজি রোড সর্বজনীনের মণ্ডপসজ্জায়। পুজো কমিটির সভাপতি ইন্দ্রনীল দে জানান, রামপ্রসাদের খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘর, ঘরের দাওয়াই ঢেঁকি, উঠোনে ধানের মড়াই, গরু-ছাগল, কলাগাছ সবই দেখা যাবে এই মণ্ডপে। এক কথায়, গ্রাম-বাংলার চালচিত্র ফুটে উঠেছে এই পুজো মণ্ডপে। রবীন্দ্র সরণি সর্বজনীনের এ বারের থিম, অক্ষরধাম মন্দিরের ময়ূর গেট। মণ্ডপের সামনে শিবের মাথা থেকে জল পড়বে। এ বার চাঁদ সওদাগরের ময়ূরপঙ্খী নৌকার আদলে তৈরি গোল্ডেন সূর্য ক্লাবের ৭৫ ফুট চওড়া ও ৫০ ফুট উচ্চতার মণ্ডপ রীতিমতো চোখ টানবে দর্শনার্থীদের। থার্মোকল, বাঁশ, প্লাই, ফাইবার দিয়ে তৈরি হয়ে এই মণ্ডপ। রঙ্কিণী সঙ্ঘের মণ্ডপ হীরক রাজার দেশের মগজ ধোলাই কেন্দ্রের মুখোশের আদলে তৈরি হয়েছে। রবীন্দ্র সরণি, গোল্ডেন সূর্য এবং রঙ্কিণী সঙ্ঘ এই তিনটির মণ্ডপ তৈ রি করেছেন চন্দন রায়। খাতড়া সিনেমা রোড সর্বজনীনের থিম বাঁশের কারুকার্য খচিত ঘর। পুজো কমিটির সভাপতি তাপসকুমার মণ্ডল জানান, প্রায় ১২০০ বর্গফুট এলাকা জুড়ে এই মণ্ডপ বাঁশ, বাটাম ও ভেলভেটের কাপড় দিয়ে তৈরি।
তবে এত থিমের মাঝেও খাতড়া মহাশ্মশান কালী, খাতড়া আদি ষোলো আনার পুজোর ঐতিহ্য আজও অম্লান। স্থায়ী মন্দিরে অর্ধ শতাব্দী প্রাচীন এই পুজো হয়। পুজোর পরদিন মন্দির প্রাঙ্গনে এলাকার বহু মানুষকে খিচুড়ি ভোগ খাওয়ানো হয়। মহা শ্মশান কালী মন্দিরের প্রবেশ পথে এ বার আলোয় আইফেল টাওয়ারের উজ্জ্বল উপস্থিতি ইতিমধ্যেই নজর কাড়ছে সকলের।
থিমের লড়াইয়ে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার প্রতিযোগিতা থাকলেও রেষারেষি কিন্তু নেই বললেই চলে। এটাই খাতড়ার কালীপুজোর ঐতিহ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy