জয়ন্তর দেহ শনাক্ত করছেন তাঁর বৌদি।—নিজস্ব চিত্র।
দু’দিন নিখোঁজ থাকার পরে গভীর জঙ্গলে মিলল এক কংগ্রেস কর্মীর ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। ওই ঘটনাকে ঘিরে বুধবার দিনভর উত্তপ্ত হয়ে রইল পুরুলিয়ার বলরামপুর এলাকা। নিহতের পরিবার ও কংগ্রেস নেতাদের দাবি, তৃণমূল কর্মীরা খুন করেছে ওই যুবককে। পুলিশ দেহ নিয়ে পুরুলিয়া শহরে ঢোকার পথে শিমুলিয়া মোড়ে পুলিশের গাড়ি আটকে বিক্ষোভও দেখায় কংগ্রেস। তৃণমূল অবশ্য এই খুনকে জমি সংক্রান্ত বিবাদের জের বলে দাবি করেছে। তবে এই ঘটনায় ধৃত দুর্যোধন প্রামাণিক তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী বলে এলাকায় পরিচিত।
সোমবার সকাল থেকে নিখোঁজ ছিলেন বলরামপুরের দেউলি গ্রামের কংগ্রেস কর্মী জয়ন্ত কুমার (৩২)। তাঁর বাবা সে দিনই বলরামপুর থানায় তৃণমূলের স্থানীয় ১৫ জন কর্মী-সমর্থকের বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ করেন। জয়ন্তের দাদা বিকাশের দাবি, ওই অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য মঙ্গলবার পুলিশ তাঁদের চাপ দেয়। এ কথা জানানোয় পুরুলিয়া জেলা কংগ্রেস সভাপতি ও পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী নেপাল মাহাতোর নেতৃত্বে বুধবার বলরামপুর থানা ঘেরাওয়ের কর্মসূচি নেয় কংগ্রেস। এর পরেই পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল জয়ন্তের খোঁজে তল্লাশি চালায়।
এ দিন সকাল ৮টা নাগাদ দেউলি থেকে সাত-আট কিলোমিটার দূরে ইচাডি জঙ্গলের গভীরে একটি শুকনো খালের ভিতরে জয়ন্তের দেহ মেলে। মৃতের মুখ থেঁতলানো ছিল। পুলিশের অনুমান, পাথর বা ওই জাতীয় কিছু দিয়ে খুন করা হয়েছে। দেহে পচন ধরে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। জঙ্গলের গভীরে একটি খালের মধ্যে মৃতদেহটি পড়েছিল। পুরুলিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্য বলেন, “অপহরণের অভিযোগ পেয়ে দুর্যোধন প্রামাণিক নামে এক জনকে ধরা হয়েছিল। ধৃতের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলার সঙ্গে খুন ও প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার ধারাও যুক্ত হয়েছে।”
নিহত যুবকের বাবা মহাবীর কুমার জানান, রবিবার রাতে জয়ন্ত গ্রামেই তাঁদের অন্য বাড়িতে শুতে গিয়েছিলেন। রবিবার সকাল থেকে তাঁর খোঁজ মেলেনি। এই ঘটনার দু’দিন আগে জয়ন্তদের বাড়িতে একটি হামলা হয়। তাঁর বৌদির শ্লীলতাহানি করা হয় বলে অভিযোগ। ওই বধূ পুলিশের কাছে, তৃণমূলের স্থানীয় কিছু কর্মী-সমর্থকের বিরুদ্ধে হামলা ও শ্লীলতাহানির অভিযোগ দায়ের করেন। তার পরেই গ্রামে দর্জির দোকান চালানো জয়ন্তর নিখোঁজ-হওয়া। কংগ্রেসের অভিযোগ ছিল, জয়ন্ত এলাকায় তাদের সক্রিয় কর্মী হওয়ায় তৃণমূলই তাঁকে অপহরণ করেছে।
এক সময়ে মাওবাদীদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বলরামপুরে গত বিধানসভা ভোটের পর থেকেই তৃণমূলের আধিপত্য। পুরুলিয়া জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো এই কেন্দ্র থেকেই নির্বাচিত বিধায়ক। কংগ্রেস সূত্রের খবর, এ বার ভোটে জয়ন্ত কংগ্রেস প্রার্থী নেপাল মাহাতোর হয়ে এলাকায় প্রচারের দায়িত্ব নেওয়ার পাশাপাশি দলের সংগঠন বাড়াতেও উদ্যোগী হয়েছিলেন। আবার স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, জয়ন্তদের পরিবারের সঙ্গে গ্রামেরই কয়েক জন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে জমি নিয়ে বিবাদ রয়েছে। নেপালবাবুর অভিযোগ, “জয়ন্ত ওই এলাকায় দ্রুত আমাদের সংগঠন গোছানোর কাজ করছিল। সে কারণেই জমি সংক্রান্ত বিবাদকে সামনে রেখে ওকে খুন করা হয়েছে। ঘটনার পিছনে তৃণমূলের যোগ আছে।”
শান্তিরামবাবুর অবশ্য বক্তব্য, “আমি ওই এলাকা থেকে খবর নিয়ে জেনেছি, জমি সংক্রান্ত বিবাদের জেরেই এই খুন। অহেতুক এতে রাজনীতি জড়ানো হচ্ছে। বরং আমি ওই যুবককে অপহরণের খবর পাওয়ার পরে পুলিশ সুপারকে ঘটনার তদন্ত করতে বলি।”
ঘটনা হল, নেপালবাবু পুরুলিয়ায় প্রার্থী হওয়া ইস্তক শাসক দলকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছেন। এ রাজ্যের একাধিক আসনে কংগ্রেস প্রার্থীদের নিয়ে দলের নিচুতলার কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকলেও নেপালবাবুর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে পুরুলিয়া জেলা কংগ্রেসে কোনও প্রশ্নই ছিল না। বরং নেপালবাবু প্রার্থী হওয়ায় নতুন উদ্যমে কংগ্রেস কর্মীরা প্রচারে নেমেছিলেন। এমনকী, জেলা তৃণমূলের বড় অংশের আশঙ্কা, বাঘমুণ্ডির বিধায়ক নেপালবাবু তাঁর নিজস্ব প্রভাবে প্রচুর ভোট কেটে নিলে তৃণমূলেরই বাড়া ভাতে ছাই পড়তে পারে।জয়ন্তের খুনের ঘটনায় প্রশ্ন উঠে গিয়েছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। নেপালবাবু বলেন, “পুলিশ বিকাশকে বলেছিল, তারা অভিযোগ তুলে নিলে জয়ন্তকে খুঁজে বের করে দেওয়া হবে।” বিকাশেরও দাবি, “আমাকে থানার এক পুলিশকর্মী ওই কথা বলেছিলেন। আমি বলি, অভিযোগ তোলার প্রশ্নই নেই। আগে
ভাইকে খুঁজে আনুন।” এর পরেই জয়ন্তকে খুঁজে বের করার দাবিতে বলরামপুর থানা ঘেরাওয়ের কর্মসূচি নেয় কংগ্রেস।
এই খবর পেতেই জেলার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীরকুমার এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী মঙ্গলবার সারারাত বলরামপুরের বিভিন্ন এলাকায় জয়ন্তর খোঁজে তল্লাশি চালায়। এ দিন সকালে দেহ মিলতেই সেই খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বলরামপুর ব্লক কংগ্রেস সভাপতি সুভাষ দাস বলেন, “পুলিশ জঙ্গল থেকে দেহ থানায় না নিয়ে গিয়ে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আমরা পুলিশের কাছে জানতে চাই, কোনও কিছুকে ধামাচাপা দিতেই কি দেহ সরাসরি পুরুলিয়ায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?” জেলা পুলিশের এক কর্তা অবশ্য পরে বলেন, “সকাল থেকে বলরামপুর থানায় কংগ্রেসের বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল। তখন দেহ থানায় পৌঁছলে পরিস্থিতি ঘোরালো হতে পারত। তা এড়াতেই সরাসরি ঘটনাস্থল থেকে দেহ মর্গে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।”
ইতিমধ্যে পুরুলিয়া থেকে নেপালবাবু ও জেলা কংগ্রেসের অন্য নেতারা বলরামপুরের পথে রওনা দিয়েছেন। স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে জয়ন্তর দেহ পুরুলিয়ায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে খবর পেয়েই মাঝপথেই থেমে যান নেপালবাবুরা। কিছু পরেই বলরামপুর-পুরুলিয়া রাস্তায়, পুরুলিয়া শহরে ঢোকার আগে শিমুলিয়া মোড়ে পুলিশের গাড়ি আটকে দেওয়া হয়। কংগ্রেস কর্মীরা রাস্তায় বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। পৌঁছে যায় পুলিশ বাহিনী। পুলিশ সুপারের সঙ্গে মোবাইলে তর্ক শুরু হয় নেপালবাবুর। এমন সময় নিহতের দাদা এক পুলিশকর্মীকে দেখিয়ে বলে ওঠেন, “ইনিই আমাকে অভিযোগ তুলে নিতে বলেছিলেন।” জেলা কংগ্রেস সভাপতি সেই অভিযোগও ফোনে এসপি-কে জানান। শেষ পর্যন্ত এসপি-র অনুরোধে তাঁরা দেহ পুরুলিয়ার মর্গে নিয়ে যেতে আপত্তি না করলেও দাবি তোলেন, জয়ন্তর বৌদিকে শিমুলিয়ায় আসতে হবে। কারণ তিনিই জঙ্গলে মৃতদেহ শনাক্ত করেছিলেন। এই দেহ সেই দেহই কি না, তা তিনি নিশ্চিত করলে তবেই পুলিশকে যেতে
দেওয়া হবে। চাপে পড়ে পুলিশ বলরামপুর থেকে জযন্তর বৌদিকে নিয়ে আসে। তার পরে কংগ্রেস কর্মীরা দেহ ছেড়ে দেন।
এ দিন হাসপাতাল থেকে দেহ পাওয়ার পরে কংগ্রেস কর্মীরা পুরুলিয়া শহরে জেলা অফিসে জয়ন্তকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। পরে বলরামপুরেও কড়া পুলিশি প্রহরায় তাঁর দেহ নিয়ে মিছিল হয়। পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করে নেপালবাবু দাবি করেছেন, যে পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছে নিহতের পরিবার, তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করতে হবে। দোষ প্রমাণিত হলে উপযুক্ত ব্যবস্থাও নিতে হবে। পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীরকুমার বলেন, “কংগ্রেস নেতারা আমার কাছে কিছু অভিযোগ করেছেন। বলেছি লিখিত অভিযোগ দিলে সব অভিযোগেরই তদন্ত হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy