বৃহস্পতিবার টিকে রয়েছে এটুকুই।
রাতের বেলায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল পঞ্চায়েত সদস্যের বাড়ি। কেঁপে উঠেছিল গ্রাম। মৃত্যু হয়েছিল তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যের দুই ভাইয়ের।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে খয়রাশোলের আহম্মদপুর গ্রামে ভয়াবহ বিস্ফোরণের স্মৃতি এখনও তাজা। বুধবার গভীর রাতে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল খয়রাশোল ব্লকেরই লোকপুর থানা এলাকার নওপাড়ায়। আর তার পরেই খয়রাশোল আর বিস্ফোরণ— যেন দুই সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে আতঙ্কিত এলাকাবাসীর কাছে। শুধু এ বছরের হিসেব ধরলেই গত পাঁচ মাসে বীরভূমের এই ব্লকে তিন তিনটি বড় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। মৃত্যু হয়েছে চার জনের।
নওপাড়ার ঘটনায় দুষ্কৃতীদের দাপট ঠিক কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থলে পৌঁছেই তা মালুম পাওয়া গেল। একটা নবনির্মিত প্রায় হাজার বর্গফুটের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। ৯০ শতাংশ ছাদ মাটিতে পড়ে রয়েছে। ভেঙে টুকরো হয়ে গিয়েছে ঢালাই পিলার, দরজা-জানালা। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কংক্রিটের পিলার, চাঙড়। সেই চাঙড়ের ধাক্কায় এবং প্রচণ্ড শব্দে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কেন্দ্রটির পাশে থাকা কয়েকটি বাড়ি। ঘটনাস্থল ঘিরে রয়েছে পুলিশ। ছিলেন লোকপুর থানার ওসি আফরোজ হোসেন এবং দুবরাজপুর (বি)-এর সার্কেল ইন্সপেক্টর দেবাশিস দাস-সহ পুলিশ বাহিনী। সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে দেখছেন আতঙ্কিত এলাকাবাসী। কিছু পরেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলেন ডিএসপি (হেডকোয়ার্টার) ধ্রুব দাসও। তখনই নিরাপত্তার প্রয়োজনে সরিয়ে দেওয়া হল ঘটনাস্থলের পাশাপাশি থাকা লোকজনকে।
বিস্ফোরণস্থল ঘুরে দেখছেন বম্ব স্কোয়াডের কর্মী।
এ দিকে, রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতায় আতঙ্ক কাটছে না ভেঙে পড়া অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের আশপাশের বাসিন্দাদের। ছেলে জয়নাল বরাত জোরে বেঁচে যাওয়ায় উপরওয়ালাকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন তাঁর মা হাজু বিবি। আতঙ্কিত নাসিম বিবি, নাজমা বিবিরা বলছেন, ‘‘দিনভর আমাদের বাচ্চারা তো ওখানেই খেলত। ওদের খেলার সময় কিছু ঘটে গেলে কী হতো?’’
তার অবশ্য উত্তর নেই পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের কাছে। বিডিও তারকনাথ চন্দ্র দাবি করেছেন, লক্ষাধিক টাকা খরচ করে ওই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রটি তৈরি করা হয়েছিল। তৈরি হওয়ার এক বছর পরেও কেন তা চালু করা গেল না, তা খতিয়ে দেখার আশ্বাসও তিনি দিয়েছেন। যদিও বিস্ফোরণের ফলেই বোঝা গিয়েছে, ওই আইসিডিএস নিয়ে প্রশাসনের নানা স্তরে টালবাহানা চলেছে। কারণ, ওই কেন্দ্রটি আদৌ আইসিডিএস কিনা, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে বলে দাবি করেছেন সুসংহত শিশুবিকাশ দফতরের জেলা প্রকল্প আধিকারিক অরিন্দম ভাদুরি। স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ, প্রশাসনের কর্তাদের এই চাপানউতোরের ফাঁক গলেই ওই আইসিডিএস কেন্দ্রকে নিজেদের আখড়া বানিয়ে ফেলেছিল দুষ্কৃতীরা।
অথচ অতীতেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে থাকা দুষ্কৃতীদের দাপটে বারবার খয়রাশোলের শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে বলে অভিযোগ। তৃণমূলের দুই ব্লক সভাপতি খুন হয়েছে। বোমাবাজি, সংঘর্ষও লেগেই রয়েছে। তার পরেও শান্তি ফেরাতে পুলিশ-প্রশাসনের মধ্যে তেমন উদ্যোগ দেখেননি বাসিন্দারা। আহম্মদপুর-বিস্ফোরণ এবং এ দিনের ঘটনার মাঝেও তার সাক্ষী থেকেছে খয়রাশোল। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বিস্ফোরণ হয় লোকপুর থানারই শিবপুর গ্রামে। এলাকার তৃণমূল কর্মী বলে পরিচিত বিপদ বাউড়িদের খামার বাড়িতে বোমা বানোনের সময় শ্রীনাথ বাউড়ি এবং পূর্ণচন্দ্র বাউড়ি নামে দুই যুবকের মৃত্যু হয়। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় তিরিশের আশপাশে থাকা ওই যুবকদের বাড়ি ছিল খয়রাশোল থানার আমাজোলা গ্রামে। ঘটনার পরে দেহ লোপাটেরও চেষ্টা হয়েছিল। ঘটনাস্থল থেকে বেশ খানিকটা দূরে পুকুরপাড় থেকে দেহগুলি উদ্ধার করেছিল পুলিশ। এখানেও প্রাথমিক ভাবে খয়রাশোলের বহু চর্চিত অশোক ঘোষ এবং অশোক মুখোপাধ্যায় গোষ্ঠীর অনুগামীদের মধ্যে বিবাদকেই দায়ী করা হয়েছিল। যদিও তদন্ত শেষ হওয়া এখনও বাকি। তারই মধ্যে এই ঘটনা।
এলাকা ঘিরে রয়েছে বাহিনী। দূরে দাঁড়িয়ে আতঙ্কিত নওয়াপাড়ার মানুষ।
এখনও জীবনহানির খবর না থাকলেও বিস্ফোরণের ভয়াবহতায় আগের দু’টি ঘটনাকেও ছাপিয়ে গিয়েছে নওপাড়া। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, সকেট জাতীয় বোমা ফেটে ঘটনাটি ঘটেছে। কিন্তু, সংখ্যায় এবং পরিমাণে তা বিশাল আকারে ছিল বলেই এত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিস্ফোরকের মান যা-ই হোক, প্রতিনিয়ত বিস্ফোরণের পরে একটা প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে, কেন এত বিস্ফোরণের ঘটনা? নেপথ্যে উঠে আসছে সেই পঞ্চায়েত ও কয়লা কারবারে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লড়াইয়ের কথাই।
পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, ওই কেন্দ্রে একটি গোষ্ঠীর লোকেদের যাতায়াত ছিল। ছিল সমাজবিরোধীদের উপস্থিতিও। অঙ্গওয়াড়ি কেন্দ্রটি এমন জায়গায় অবস্থিত, রাতের অন্ধকারে গ্রাম ঘুমিয়ে পড়লে সেখানে যাতায়াত বা কোনও অসামাজিক কাজ করাটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেই সুযোগেই ওই বিস্ফোরক মজুদ করা হয়েছিল বলে ধারণা পুলিশের।
ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy