বিস্ময়ে: আসছে আলো। গ্রামে বিদ্যুতের খুঁটি নিয়ে ব্যস্ততা। নিজস্ব চিত্র
রবিবার সকালে গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের বারান্দায় চলছিল কর্মকাণ্ড। নরম পানীয়ের স্বচ্ছ বোতলের মধ্যে থেকে যেই না আলো ঠিকরে বেরিয়েছে, অমনি যেন খুশির ঠিকানা নেই গোটা গ্রামের।
খুশিতে সামিল গ্রামের সাত থেকে সত্তর সকলেই। হওয়ারই কথা, স্বাধীনতার সাত দশক পরে, বাঁদরবেড়িয়া নামে বীরভূমের সীমানা লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের ওই আদিবাসী গ্রামেটিতে যে এই প্রথম আলো জ্বলল!
এ বার থেকে আর ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত আর নয়, গ্রামবাসীদের আনন্দ সেই জন্য।
যদিও সরকার নয়, কলকাতার একটি বাণিজ্যিক সংস্থায় আইটি সেক্টরে কর্মরত অরুন্ধতী মৈত্র নামে এক মহিলাকর্মীর অনুরোধে প্রত্যন্ত গ্রামটির প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠোনে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে আলো পৌঁছানোর কাজ হাতে নিয়েছে লিটার অফ লাইট নামে দক্ষিণভারতের ব্যাঙ্গালুরু-র এক সংস্থা। দিন পাঁচেকের মধ্যেই তা সম্পন্ন হবে।
কীভাবে এটা সম্ভব হল, কেনই বা কলকাতা থেকে সূদুর ঝাড়খণ্ডের এই আদিবাসীগ্রাম নিয়ে পড়লেন আইটি কর্মী। কলকাতার বালিগঞ্জের ওই বাসিন্দা অরুন্ধতীর কাছ থেকে জানা গেল, কাজের ফাঁকে একটু সমাজসেবা করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। চেয়েছিলেন সুন্দরবনে এলাকার মানুষের জন্য কিছু করতে। কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে শুধু অর্থ সাহায্য করে দায় সারা নয়, একটু হলেও নিজে জড়িয়ে পড়তে সমাজসেবার কাজে।
বছর দুই আগে বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী পান্নালাল দাশগুপ্তের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা টোগোর সোসাইটি-র ডিরেক্টরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন ২৫ হাজার টাকার একটি চেক নিয়ে। কিন্তু সুন্দরবন নয়, খয়রাশোল লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের ওই আদিবাসী গ্রামটিকে বেছে দিয়েছিলেন তিনি। শিশুদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য একটি নন ননফর্মাল স্কুলগড়ার পারামর্শ দিয়ে। সেই শুরু।
ঝাড়খণ্ডের জামতারা জেলার কুণ্ডহীত ব্লকের ওই গ্রামটিতে ৪০ ঘর পাহারিয়া সম্প্রদায় আদিবাসী পরিবারের বাস। হত দরিদ্র গ্রাম। পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র নেই। রাস্তা নেই, বিদ্যুৎ নেই। অনেক নেই এর মধ্যে পাহারিয়া টোলা নামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে।
কিন্তু এখানে ননফার্মাল স্কুল আবার কেন, অরুন্ধতীর মনেও এমন প্রশ্ন এসেছিল। কিন্তু এসে দেখেন, সরকারি প্রাথমিক স্কুলটি অনিয়মিত ভাবে চালান একজন প্যারা টিচার। প্রায় কিছুই শেখেনি শিশুরা।
ওই শিক্ষককে বলেই ১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ওই স্কুলেই সকাল বেলায় শুরু হয় নন ফর্মাল স্কুলটি। পাশের গ্রামের এক একাদশ শ্রেণির আদিবাসী ছাত্রকে দায়িত্ব দেওয়া হয় শিশুদের পড়ানোর। কিন্তু একটু একটু করে হতদরিদ্র মানুষগুলোর সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠে অরুন্ধতীর। টোগোর সোসাইটির রাজনগর খয়রাশোলে ইউনিটকে পাশে নিয়ে কখনও ব্যক্তিগত উদ্যোগে কখনও বন্ধুদের সাহায্যে গ্রামের পানীয়় জলের কূপ খনন, পুকুর সংস্কারের মতো নানা কাজ করেছেন ওই আইটি কর্মী।
এ বার আলো।
অরুন্ধতী বলছেন, গ্রামের মানুষের সবচেয়ে বড় চাহিদা ছিল, যদি রাতের বেলায় গ্রামে আলো জ্বলে। আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে জানতে পারি ‘লিটার অফ লাইট গ্লোবালে’র কথা। যাঁরা এ দেশ ছাড়াও একাজ করছে অন্য দেশগুলিতেও।
ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ওরাই এ দেশে ওদের ব্যাঙ্গালুরুর ঠিকানা দেয়। যোগাযোগ করে কাজ হয়। আগে ফেব্রুয়ারি মাসে এসে নমুনা স্বরূপ একটা সৌর পথবাতি গ্রামে দিয়ে গিয়েছিল। পরে সংস্থা স্থির করে, আরও ৫০টি সৌরপথবাতি দেবে। এই গ্রামের জন্য ৩০টি। আলো জ্বললে যে রাতের ছবিটাই বদলে যাবে।
আরও পড়ুন:আতর-সুর্মা-জর্দা ফেরাতে এ বার ব্র্যান্ড চিৎপুর
ঠিকই। গ্রামের যুবক নেপাল পাহাড়িয়া, শান্ত পাহাড়িয়ার বলছেন, সন্ধায় নামতেই গ্রামটা ঘুমিয়ে যেত। এ বার আলো জ্বলবে, বাচ্চাগুলো পড়াশুনা করেবে। সকলে বাইরে বেরোবে। অনেক পড় প্রাপ্তি। গ্রামের বৃদ্ধ বারু পাহারিয়া কিংবা যাঁদের বাড়ির উঠোনে আলো জ্বলবে সেই পার্বতী, সোনালি, রেণুকা পাহারিয়ারা বলছেন এই গ্রামে যে আলো জ্বলবে সেটাই বিশ্বাস হচ্ছিল না।
গ্রামে বিদ্যুতের খুটি তার টাঙানো হয়ছে এক বছর আগে। কিন্তু ওখানেই থেমে গিয়েছে। আজ মনে হচ্ছে স্বপ্ন পূরণ হল। সকাল থেকেই গ্রামের প্রত্যেকেই নিজেদের মত আলো লাগানোর কাজে হাত দিয়েছেন।
সংস্থার হয়ে গ্রামে আলো লাগাতে এসেছেন বছর পঞ্চান্নর পঙ্কজ দীক্ষিত। দীর্ঘ দিন আই সেক্টরের কর্মী ছিলেন তিনি। বলছেন, লো কস্ট ডিজাইনের এই আলোগুলো।
এক একটা ইউনিটের খরচ সাড়ে তিন হাজার টাকার মতো। অনুষঙ্গ বলতে একটা বহুজাতিক সংস্থার নরম পানীয়ের ১.২৫ লিটার স্বচ্ছ বোতল।
একটা ব্যাটারি কিছু পিভিসি পাইপ একটা এক বর্গফুটের সোলার প্যানেল আর একটা ইলেক্ট্রনিক সার্কিট। কিন্তু এটাই মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy