গ্রেফতারের দাবিতে পোস্টার।—নিজস্ব চিত্র।
তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব রাইপুরে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে খোদ দলের যুব সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তা দেখে গিয়েছেন। রবিবার তাঁর সামনেই ধানঘরি গ্রামে জেলা পরিষদের এক কর্মাধ্যক্ষ দলেরই লোকজনের হাতে মার খান। কিন্তু তারপরেও দ্বন্দ্ব থেমে নেই। সোমবার রাইপুরের সবুজ বাজারে তৃণমূলের এক গোষ্ঠীর দলীয় কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে বেদখল করার অভিযোগ উঠল দলেরই অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
বৃহস্পতিবার রাতে মটগোদায় দলীয় কার্যালয়ের বাইরে মোটরবাইকে আসা তিন দুষ্কৃতীর গুলিতে নিহত হন তৃণমূলের রাইপুর ব্লক কার্যকরী সভাপতি অনিল মাহাতো। জেলা নেতাদের একাংশ প্রথমে ‘মাওবাদীদের কাজ’ বলে দাবি করলেও নিহতের ঘনিষ্ঠেরা দাবি করেন, দলের দ্বন্দ্বেই এই খুন। সে ক্ষেত্রে সন্দেহের তির ওঠে অনিলবাবুর বিপক্ষ ব্লক সভাপতি জগবন্ধু মাহাতোর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। বস্তুত এলাকার পরিস্থিতি তার পর থেকে অন্যরকম হয়ে পড়ায় রাইপুরে তেমন একটা বের হতে দেখা যাচ্ছে না জগবন্ধুবাবুকে। সেই সুযোগে সোমবার রাইপুর সবুজ বাজারে জগবন্ধুবাবুর দলীয় কার্যালয় জোর করে দখল করে নেওয়ার অভিযোগ উঠল অনিলবাবুর ঘনিষ্ঠ রাইপুর ব্লক যুব তৃণমূল সভাপতি রাজকুমার সিংহের লোকজনের বিরুদ্ধে। সেই সময় জগবন্ধুবাবুর কিছু লোকজন দলীয় কার্যালয়ে ছিলেন। বিপক্ষ গোষ্ঠীর লোকজন অফিসে ঢুকে তাঁদের মেরে অফিস থেকে বের করে দেয় বলে অভিযোগ।
জগবন্ধুবাবুর দাবি, “সবুজ বাজারের আমার পার্টি অফিসে ঢুকে দলীয় কর্মীদের মারধর করে বের করে দিয়েছে অনিলের কিছু অনুগামী। ঘটনাটি আমি ফোনে পুলিশকে জানিয়েছি।” আবার রাজকুমারের দাবি, ‘‘ওই অফিস অনিলদারই ছিল। তাই বেদখল করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।’’ কিন্তু এতে আখেরে দলের ভাবমূর্তিই যে নষ্ট হচ্ছে তা মানছেন জেলা নেতাদের অনেকেই। এক নেতার কথায়, ‘‘ওখানে যা ঘটে যাচ্ছে, তা দলের পক্ষে মোটেই ভাল নয়। সব পক্ষকেই এখনই সংযত না হলে জানি না, আরও কী ঘটবে!’’ এলাকায় কার্যত কোণঠাসা অবস্থায় চলে যাওয়া জগবন্ধুবাবুও বলছেন, “ব্লকের পরিস্থিতি দিনের পর দিন খারাপ হচ্ছে। এই অবস্থায় পুলিশ দ্রুত দোষীদের গ্রেফতার করে অশান্তি থামাক।”
কিন্তু সোমবার পর্যন্ত পুলিশ ওই খুনের ঘটনায় একজনকেও গ্রেফতার করতে পারেনি। তদন্তকারীদের কাছে স্পষ্ট নয় খুনের কারণও। এ দিকে নিহত নেতার পরিবারকে রবিবার অভিষেক সমবেদনা জানাতে এসে বলে যান, পুলিশকে তিনদিনের মধ্যে দোষীদের গ্রেফতার করতে বলা হয়েছে। বস্তুত এরপরেই পুলিশের উপর দোষীদের গ্রেফতারের ব্যাপারে যে কিছুটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে তা ঠারেঠোরে মানছেন জেলা পুলিশের কেউ কেউ।
অবশ্য ইতিমধ্যেই খাতড়ার এসডিপিও-র নেতৃত্বে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল তদন্ত চালাচ্ছে। সুলেখাদেবী শুক্রবার থানায় যে সাত জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন, তাঁদের কয়েকজন এলাকায় অনিলবাবুর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর বলেই নিহতের সঙ্গীদের দাবি। অভিযুক্তদের কয়েকজন এবং নানা ভাবে অনিলবাবুর সঙ্গে পরিচিত থাকা লোকজনকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদও করছেন। কিন্তু খুনের ‘মোটিভ’ নিয়ে ধন্দ কাটছে না তদন্তকারীদের। খুনের পরেই অনিল ঘনিষ্ঠেরা দাবি করেছিলেন, রাইপুরের তৃণমূল ব্লক সভাপতি হিসেবে অনিলবাবুর নামে জল্পনা চলছিল। এর মধ্যে তাঁকে খুন করে বিরুদ্ধ গোষ্ঠী কাঁটা সরিয়ে ফেলল। এখনও পর্যন্ত পুলিশের হাতে ওই দাবি সমর্থন করার মতো কোনও তথ্য-প্রমাণ উঠে আসেনি বলে পুলিশের একটি সূত্রে জানা যাচ্ছে।
আর এ থেকেই প্রশ্ন উঠছে অনিলবাবুর খুনের পিছনে তবে কি অন্য কোনও রহস্যের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছে পুলিশ? তদন্তকারীদের অনেকেরই মতে, নিছক গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে এই খুন নাও হতে পারে। খুনের পিছনে ঠিকাদার যোগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তদন্তকারীরা। ঠিকাদারদের এলাকায় প্রশাসনিক কাজ পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব কাজ করে বহু ক্ষেত্রেই। রাইপুর পঞ্চায়েত সমিতিতে প্রভাব বিস্তার করাকে কেন্দ্র করে অনিলবাবু ও জগবন্ধুবাবুর বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে একাধিকবার। বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলে প্রায়ই সরব হতেন অনিলবাবু। তাই সে ক্ষেত্রে পথের কাঁটা সাফ করতেই পিছন থেকে কোনও ঠিকা সংস্থার এই খুনে মদত থাকলেও থাকতে পারে বলে মনে করছেন তদন্তকারীদেরই একটি অংশ।
এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে রাইপুরের বিডিও দীপঙ্কর দাসের সঙ্গেও কথা বলেছেন তদন্তকারীরা। পঞ্চায়েত সমিতির ঠিকাদারদের তালিকা তৈরি করে তাঁদেরও জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছে পুলিশ। বিডিও দীপঙ্করবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘তদন্তের ব্যাপারে আমি কিছু বলব না।’’ ইতিমধ্যে দলে জগবন্ধুর ‘কাছের’ লোকেদের একাংশ দাবি তুলেছেন, অনিলবাবুর সঙ্গে জগবন্ধুবাবুর বিরোধের সুযোগ নিয়ে অন্য কেউ ফায়দা তুলতে চাইছে কি না, তা দেখা দরকার। পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা বলেন, “খুনের কারণ কী হতে পারে তা জানতে বিভিন্ন দিকই আমরা খতিয়ে দেখছি।’’ তদন্তের জল কোন দিকে গড়ায় তাকিয়ে রাইপুর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy