কর্মিসভায় এসে দলের বিক্ষুব্ধদের বিরুদ্ধে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবে দল থেকে বহিষ্কারের নিদান দিয়ে গিয়েছিলেন তৃণমূলের পুরুলিয়া জেলার পর্যবেক্ষক তথা সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। সেচমন্ত্রীর সেই ঘোষনার ছয়দিন পেরিয়ে গেলেও বিক্ষুব্ধদের বিরুদ্ধে (বিশেষ করে যাঁরা দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে গোঁজ হিসাবে দাড়িয়েছেন) কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেননি পুরুলিয়া জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। পাশের বাঁকুড়ায় কিন্তু ইতিমধ্যেই বিক্ষুব্ধ প্রার্থীদের বহিষ্কার করা শুরু করেছে শাসকদল।
যদিও জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো মঙ্গলবার দাবি করেছেন, ‘‘পুরুলিয়া ও রঘুনাথপুর পুরসভায় দলের যে-সব বিক্ষুব্ধ নির্দল হিসাবে দাঁড়িয়েছেন বা অন্য দলের প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।” বিক্ষুব্ধদের পাল্টা দাবি, বহিষ্কারের কোনও চিঠি বা নির্দেশ তাঁরা এখনও পাননি। অথচ চিঠি দিয়ে বা নিদেনপক্ষে সাংবাদিক সম্মেলন করে বা প্রেস বিবৃতি দিয়েও দল থেকে বহিষ্কার করা বা দলে কাউকে নেওয়ার কথা জানানোর রেওয়াজ রয়েছে তৃণমূলে। বিক্ষুব্ধদের ক্ষেত্রে কিন্তু চিঠি দেওয়া বা প্রেস বিবৃতি দেওয়ার পথে হাঁটেননি দলের জেলা নেতৃত্ব। শান্তিরামবাবু বলেন, “বিক্ষুব্ধদের দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়ে গেছে। শীঘ্রই তাঁরা ওই চিঠি পাবেন।’’ সব মিলিয়ে বিষয়টি নিয়ে দলের ভিতরেই বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে পুরুলিয়ায় সম্প্রতি বিক্ষুব্ধদের দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা করার কথা জানিয়ে বিধায়ক তথা পুরসভার প্রার্থী কেপি সিংহদেওয়ের নাম উল্লেখ করা একটি প্রচারপত্র প্রকাশ্যে আসায়। ওই প্রচারপত্রে পাঁচ বিক্ষুব্ধের নাম উল্লেখ করা জানানো হয়েছে, পুরুলিয়ার পর্যবেক্ষক ও জেলা সভাপতির নির্দেশ অনুযায়ী ওই পাঁচ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
যদিও বিধায়ক এ দিন দাবি করেছেন, ওই প্রচারপত্রটি তিনি বের করেননি। কে পি সিংহদেও বলেন, ‘‘দলীয় নির্দেশ অমান্য করে যাঁরা নির্দল হিসাবে লড়ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। ফলে, এই ধরনের প্রচারপত্রের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দলের কিছু কর্মী এই প্রচারপত্র ছাপিয়েছেন। কিন্তু, এর সঙ্গে আমার যোগ নেই।” তাঁর সংযোজন, “প্রচারপত্রে আমার নাম প্রকাশক হিসাবে থাকলে তার দায়ভার আমি নিতাম। কিন্তু এখানে সেই ধরনের কিছুই নেই।’’
ঘটনা হল, দলের টিকিট না পেয়ে এ বার পুর-নির্বাচনে পুরুলিয়া ও রঘুনাথপুরে বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন তৃণমূলের একাধিক নেতা। পুরুলিয়ায় তো তৃণমূলের বিদায়ী পুরপ্রধান তারকেশ চট্টোপাধ্যায়, দলের অন্যতম জেলা সম্পাদক সুদীপ মুখোপাধ্যায়, বিদায়ী কাউন্সিলর প্রদীপ মুখোপাধ্যায় কিংবা জেলা কমিটির সদস্য গোবিন্দ মুখোপাধ্যায় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। তারকেশবাবু, প্রদীপবাবু, গেবিন্দবাবুরা কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল প্রার্থীও হয়েছেন। সুদীপবাবু কংগ্রেসের প্রতীকেই লড়ছেন। টিকিট না পেয়ে দল ছেড়েছেন শাসকদলেরই তিন নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর সুনয় কবিরাজ। ওই ওয়ার্ডে নির্দল প্রার্থী হয়েছেন সুনয়বাবুর স্ত্রী রিম্পাদেবী। রঘুনাথপুরেও টিকিট না পেয়ে নির্দল হিসাবে লড়ছেন তৃণমূলের বিদায়ী কাউন্সিলর সাধনা মোহান্ত, আরএসপি থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়া বিদায়ী কাউন্সিলর নাজিয়া পারভিনের স্বামী তথা তৃণমূল কর্মী শেখ মধু। বিক্ষুব্ধ হয়ে নির্দল হিসাবে লড়ছেন তৃণমূলেরই বিক্রম বাউরি, বাসন্তী বাউরি। ফলে তৃণমূলের গোঁজ প্রার্থীদের তালিকা বেশ দীর্ঘই দুই পুরসভায়। এই গোঁজ কাটা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তায় রয়েছেন দুই পুরসভার তৃণমূল প্রার্থীরা।
এই অবস্থায় খোদ জেলার পর্যবেক্ষকের ঘোষণার পরেও বিক্ষুব্ধদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করছেন তৃণমূলেরই নিচুতলার কর্মী-সমর্থকদের বড় অংশ। বিশেষ করে যেখানে জেলার পর্যবেক্ষক রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় গত ১ এপ্রিল পুরুলিয়া ও রঘুনাথপুরের দু’টি কর্মিসভাতেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী টিকিট না পেয়ে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্দল হিসাবে দাঁড়িয়ে পড়া বা অন্য দলে ভিড়ে যাওয়া তৃণমূল নেতা-কর্মীদের দল থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বহিষ্কার করা হবে। ওই সিদ্ধান্তকে সমর্থনও করেছিলেন নিচুতলার কর্মীরা। কিন্তু, ছ’দিন পরেও সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন না দেখে তাঁরা হতাশ। এমনকী, দুই পুরসভার কিছু তৃণমূল প্রার্থীর আশঙ্কা, ‘বিক্ষুব্ধদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা না নিলে তার প্রভাব নির্বাচনে পড়বে। পুরুলিয়ার বিধায়কও বলেছেন, ‘‘দলের স্বার্থেই জেলা সভাপতির উচিত বিক্ষুব্ধদের বিরুদ্ধে জেলার দলীয় পর্যবেক্ষকের ঘোষণামতো দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। না হলে কর্মীদের মধ্যে ভূল বার্তা যাচ্ছে।”
তবে, দল থেকে তাঁদের বহিষ্কার করার বিষয় নিয়ে আদৌও মাথা ঘামাতে নারাজ বিক্ষুব্ধেরা। পুরুলিয়ায় কংগ্রেসে যোগ দেওয়া সুদীপ মুখোপাধ্যায় বা রঘুনাথপুরের শাসকদলের বিদায়ী কাউন্সিলর সাধনা মোহান্তদের কটাক্ষ, ‘‘যাঁরা আমাদের দল থেকে বের করবেন, তাঁদেরই তৃণমূলের দলীয় সদস্যপদ রয়েছে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে!” এক ধাপ এগিয়ে তৃণমূলের দু’টি কর্মিসভাকে ‘গ্রাম্য সালিশিসভা’ হিসাবে তোপ দেগেছেন সুদীপবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy