চিতাভস্ম নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।—নিজস্ব চিত্র
তিনি চেয়েছিলেন মৃত্যুর পর রাজনোয়াগড়ের মাটিতে যেন তাঁর দেহ সমাহিত করা হয়। সেই মাটিতে একটা মহুল গাছ পোঁতা থাকবে। গাছটি সবাইকে ছায়া বাতাস দেবে।
তাঁর সেই ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে মৃত্যুর ঠিক এক মাস পরে ২৮ জুলাই রবিবার কেন্দা থানার রাজনোয়াগড় গ্রামে পশ্চিমবঙ্গ শবর-খেড়িয়া কল্যাণ সমিতির অফিস চত্বরে মহাশ্বেতাদেবীর অস্থিভস্ম সমাহিত করা হল। আর সেই মাটিতে পুঁতে দেওয়া হল একটি মহুল গাছ। শবর-খেড়িয়াদের কারও মা, কারও বা শুধুই দিদি মহাশ্বেতাদেবী পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের মাটিতে এ ভাবেই কোল পেলেন।
রবিবার স্মরণসভায় তাঁকে ঘিরে নানা অকথিত তথ্যও উঠে এল। তাতে তিনি প্রখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা নন, নিতান্ত আটপৌরে পরিবারেরই এক জন। যাঁকে শবর সমিতির সদস্যেরা নিজেদের বাড়ির লোক ভেবে এসেছেন। দারিদ্র-অপুষ্টি অশিক্ষার বেড়ায় আবদ্ধ শবরদের মুক্তির গান শুনিয়েছিলেন। তাই তিনি শবরদের এত আপন হতে পেরেছিলেন।
স্মরণসভা হচ্ছে জেনে ছুটে এসেছেন, তার এক সময়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বর্তমানে রাজ্য পুলিশের ডিজি (প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ) অনিল কুমার। এ দিনের স্মরণসভায় জেলার নানা প্রান্তের শবর খেড়িয়ারা তো বটেই, হাজির ছিলেন জেলার দুই মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো, সন্ধ্যারানি টুডু, সাংসদ মৃগাঙ্ক মাহাতো প্রমুখ।
শেষ বয়সে তাঁর চিকিৎসা করতেন কলকাতার বাসিন্দা মৌলী মুখোপাধ্যায়। এ দিন তিনি কয়েকজন সহযোগীকে সঙ্গে নিয়ে লাল শালুতে মোড়া অস্থিভস্ম কলকাতা থেকে নিয়ে আসেন। বোরো গ্রামের বাসিন্দা বিনোদ শবর বলেন, ‘‘একবার রাজনোয়াগড়ের শবর মেলায় খেতে বসেছি। দেখি মহাশ্বেতাদিও বসে গিয়েছেন। আমি পাতায় কিছুটা খিচুড়ি রেখে উঠে যাচ্ছিলাম। তিনি আমায় হাত ধরে টেনে বসালেন। খাবার নষ্ট করা চলবে না।’’ আবার মানবাজার থানার জনড়া গ্রামের ঊর্মিলা শবর তাঁকে অন্য ভাবে পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘সে বার আমার এক বছরের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে মেলায় এসেছিলাম। আসার পর থেকে ধূম জ্বর। এক কোণে চুপ করে বসেছিলাম। ওঁনার চোখ এড়ায়নি। সব শুনে নিজেই আমার ছেলের কপালে জলপটি দিতে বসে গেলেন। পরে ডাক্তার এসে দেখে ওষুধ দিলেন। সব তাঁরই নির্দেশে হয়েছে। শুনেছি ওঁর খুব নাম ডাক ছিল। কিন্তু আমরা সে সব বুঝতে পারিনি। আমাদের সঙ্গে তিনি সহজ ভাবেই মিশতেন।’’
তাঁর অনুপ্রেরণায় সমিতির অধীনে শবর বালিকাদের ছাত্রী আবাস গড়ে উঠেছিল। পুরুলিয়ার কয়েকটি ব্লক এলাকায় শবর শিশুদের শিক্ষা সম্প্রসারণে ১০৮টি স্কুল খোলা হয়েছিল। কোথাও কোথাও শবর যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে হাতের কাজ শেখানো, কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর মতো একগুচ্ছ প্রকল্প চালু হয়েছিল। অর্থের জোগান কমে আসায় ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর প্রশান্ত রক্ষিতের বক্তৃতায় তাই আক্ষেপ ঝরে পড়ে। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, শবর শিশুদের পড়ানোর ব্যবস্থা করা হবে।
এই সমিতি গড়ার পিছনে একটা ইতিহাস রয়েছে। রাজনোয়াগড় রাজ পরিবারের সদস্য গোপীবল্লভ সিংহদেও তখন স্থানীয় হাইস্কুলের শিক্ষক। স্থানীয় শবররা তাঁর কাছে ছুটে এসে জানান, পুলিশ ও প্রশাসন নানা ভাবে শবর-খেড়িয়াদের উপর নির্যাতন করছে। গোপীবল্লভ প্রথম শবরদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোঝালেন। ১৯৬৮ সালের ৭ জানুয়ারি মানবাজার ব্লকের কুদা গ্রামে প্রথম শবর সম্মেলন হয়। শবরদের সমাজের মূল স্রোতে আনার আন্দোলনের সেই শুরু। এরপরেই যোগাযোগ হয় মহাশ্বতাদেবীর সঙ্গে। ১৯৮৩ সালের ১২ নভেম্বর কেন্দা থানার মালডি গ্রামের শবর মেলায় মহাশ্বেতাদেবী যুক্ত হন।
সেই সভাতেই তাকে ‘শবর জননী’ আখ্যা দেন গোপীবল্লভ। সমিতির কার্যকরী সভাপতি করা হয় তাঁকে। সেই থেকে রাজনোয়াগড়ের সাথে মহাশ্বেতার যোগাযোগ আমৃত্যু। মৃত্যুর পরেও তিনি এই মাটিতেই রয়ে গেলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy