Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

ঘুঘুর বাসায় ঢিল, নৈতিক সমর্থন সিউড়ির

দল তাঁকে সাসপেন্ড করেছে ঠিকই। কিন্তু সিউড়ি পুরসভার ঘুঘুর বাসায় ঢিল মেরে তামাম শহরবাসীর সমর্থন কুড়োচ্ছেন তৃণমূলের ‘বিদ্রোহী বিধায়ক’ স্বপনকান্তি ঘোষ! সময়ে জল প্রকল্প শেষ না হওয়াকে ঘিরে সিউড়িবাসীর ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। কিন্তু যে মুহূর্তে বিধায়ক তৃণমূল পরিচালিত সিউড়ি পুর বোর্ডের বিরুদ্ধে ওই প্রকল্পে আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছেন তখন থেকেই সেই ক্ষোভে নৈতিক সমর্থন কুড়োচ্ছেন তিনি। বুধবার পুরসভার আর্থিক দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে বিধানসভায় ধর্নায় বসে দলের কোপে পড়েও তাই স্বপনবাবুর প্রতি নৈতিক সমর্থন বেড়ে গিয়েছে জেলা সদরে।

জলের জন্য অপেক্ষা। সিউড়ির লালকুঠিপাড়ায়। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

জলের জন্য অপেক্ষা। সিউড়ির লালকুঠিপাড়ায়। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

দয়াল সেনগুপ্ত
সিউড়ি শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:০৮
Share: Save:

দল তাঁকে সাসপেন্ড করেছে ঠিকই। কিন্তু সিউড়ি পুরসভার ঘুঘুর বাসায় ঢিল মেরে তামাম শহরবাসীর সমর্থন কুড়োচ্ছেন তৃণমূলের ‘বিদ্রোহী বিধায়ক’ স্বপনকান্তি ঘোষ!

সময়ে জল প্রকল্প শেষ না হওয়াকে ঘিরে সিউড়িবাসীর ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। কিন্তু যে মুহূর্তে বিধায়ক তৃণমূল পরিচালিত সিউড়ি পুর বোর্ডের বিরুদ্ধে ওই প্রকল্পে আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছেন তখন থেকেই সেই ক্ষোভে নৈতিক সমর্থন কুড়োচ্ছেন তিনি। বুধবার পুরসভার আর্থিক দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে বিধানসভায় ধর্নায় বসে দলের কোপে পড়েও তাই স্বপনবাবুর প্রতি নৈতিক সমর্থন বেড়ে গিয়েছে জেলা সদরে। উদ্দেশ্য যাই হোক, স্বপনবাবুর উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন জেলায় বিরোধী দলের শিবিরের লোকেরাও।

সিউড়ি পুরসভার বিরুদ্ধে ঠিক কী অভিযোগ ছিল স্বপনকান্তির?

বিধায়কের অভিযোগ, সিউড়ির জল প্রকল্প এবং বস্তি উন্নয়ন প্রকল্পে কেন্দ্রীয় অনুদানের প্রায় ১০ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকা সিউড়ি পুরসভা থেকে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছে। এই দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে দলের হাতে থাকা সিউড়ি পুরসভার নানা ‘দুর্নীতি’র খতিয়ান দিয়ে আগেই জানিয়েছিলেন স্বপন। বিধায়কের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীকে লেখার আগে দলীয় স্তরে কেলেঙ্কারির কথা জানিয়েও বিশেষ লাভ হয়নি।

জেলা তৃণমূল সূত্রের খবর, সেই চিঠিতে স্বপনবাবু জানিয়েছেন, গরমিলের কথা আঁচ করে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং স্টেট আরবান ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (সুডা) কাছে অন্তত ৫টি চিঠি লেখেন। যার একটিরও নাকি জবাব পাননি তিনি।

মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে স্বপনবাবু দাবি করেছিলেন, পুরসভার দুর্নীতির চোটেই লোকসভা ভোটে সিউড়ি শহরের ১৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৫টিতে বিজেপি-র থেকে পিছিয়ে পড়েছে তৃণমূল।

ঘটনা হল, বিধানসভা নির্বাচনের সময় সিউড়ি শহরে তৃণমূল এগিয়ে ছিল প্রায় ১৪০০০ ভোটে। লোকসভা ভোটে সেটা তো বাড়েইনি, উল্টে একলাফে তৃণমূল পিছিয়ে যায় ২৬০০ ভোটে। অশনি সঙ্কেত তখন থেকেই শাসক দলের অন্তরে। পুরভোটের ঠিক আগে দলীয় বিধায়ক তৃণমূল পরিচালিত পুরবোর্ডের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে শাসক দলকে আরও চাপে ফেলে দিলেন। জেলার তৃণমূল নেতারা আড়ালে বলছেন, যে সমস্যা ঘরোয়া ভাবে সমাধান হতে পারত, সেটা নিয়ে অহেতুক হৈ চৈ করে বিরোধী দলের হতে অস্ত্র তুলে মোটেই ভালো কাজ হয়নি।


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

সেই চিঠিতে তৃণমূল বিধায়ক স্পষ্টই জানিয়েও দিয়েছিলেন, দুর্নীতি দমনে তিনি শেষ বারের মতো দলকে সক্রিয় হতে অনুরোধ করছেন। এতে চূড়ান্ত অস্বস্তিতে পড়েছিল দল। কিন্তু, পুরসভার বিরুদ্ধে বিধায়কের আনা অভিযোগের কোনও ব্যবস্থা দলের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি বলে স্বপনবাবুর ক্ষোভ। বরং তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল সিউড়ি পুরসভাকে ক্লিনচিট দিয়েছিলেন। কিন্তু বুধবারের পর বিষয়টি একেবারে অন্য মাত্রায় পৌঁছল বলেই মানছেন দলের নীচু তলার কর্মী থেকে সিউড়ি শহরের মানুষ। বিশেষত পুর ভোটের আগে দলীয় বিধায়কের এমন পদক্ষেপ পুরভোটে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন তাঁরা।

সিউড়ি পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, সিউড়ি শহরের সবচেয়ে বড় সমস্যা পানীয় জলের সঙ্কট দূর করতে কেন্দ্রীয় প্রকল্পে (জহরলাল নেহেরু ন্যাশনাল আরবান রিনিউয়াল মিশন)২০০৭ সালে অনুমোদিত হয়। প্রকল্প ব্যয় ৯ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকা। তিন বছরের মধ্যে তত্‌কালীন কংগ্রেস পরিচালিত বোর্ড ২০১০ সাল পর্যন্ত সেই বরাদ্দের প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা পেয়েছিল। কিন্তু ততদিনে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে হয়েছে ১৪ কোটি ৪৬ লক্ষ। পরে তৃণমূল ক্ষমতাসীন বোর্ড ক্ষমতায় আসার পর ১২ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা পেয়েছে। কিন্তু ইউটিলাজেশন সার্টিফিকেট দিয়েছে ৭ কোটি টাকার। অভিযোগের সূত্রপাত সেখানেই। বিধায়ক এবং বর্তমান পুর কাউন্সিলারদের একাংশ বলছেন, “যে অ্যাকাউন্ট থেকে ওই টাকা খরচ দেখানো হয়েছে সেখানে আর কোনও টাকা পড়ে নেই। কাজও শেষ হয়নি। তাহলে টাকা গেল কোথায়?”

পুরপ্রধান উজ্বল মুখোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেছেন, “পুরসভার কর্মীদের বেতন ও অবসর প্রাপ্ত পুর কর্মীদের পেনশন দিতে ওই খাত ভাঙতে হয়েছে। উনি এখন তৃণমূল বিধায়ক, ছিলেন কংগ্রেস নেতা। যে সময় প্রকল্পগুলি এসেছে, কংগ্রেস তখন বোর্ডে ছিল। কেন সেই সময়ই কাজ শেষ হল না, তার দায় স্বপনবাবু কেন নেবেন না? আগের বোর্ডই টাকা ভাঙতে শুরু করেছিল, সেটা আমার সময় বেড়েছে। সেটা নিয়ে কোনও লুকোচুরি নেই।”

যদিও স্বপনবাবু এই দাবি মানতে নারাজ। তিনি বলেন, “এটা কোনও যুক্তি নয়। তদন্ত হয়েই সব জানা যেত আসলে টাকা কোথায় গিয়েছে।” কংগ্রেস কাউন্সিলর ইয়াসিন আখতার এবং তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দেওয়া কাউন্সিলর দীপক(বাবন) দাসেরা বলছেন, “মিথ্যা বলছেন পুরপ্রধান। প্রথমত কাজ শেষ হয়নি। যেটুকু হয়েছে সেটাও প্রথা মেনে হয়নি।” জেলা কংগ্রেসের সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মি বলেন, “শাক দিয়ে মাছ না ঢেকে, দলের বিধায়ক তাঁকে চোর বলেছেন। তিনি যে চোর নন, সেটা প্রমাণ করুন আগে।”

কার্যত শহরের নানা মহল এ দিন ছিল জলপ্রকল্পের জল্পনা ও ‘বিদ্রোহী বিধায়ক’ স্বপনবাবুকে নিয়ে এমন সরগরম। ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক কিষান পাল বলেন, “কতটা বেনিয়ম বা আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে, সেই তর্কে না গিয়েও বলা যায় দীর্ঘদিন ধরে যে মানুষ ভুগছেন বিধায়কের সৌজন্যে, এবার সেক্ষেত্রে কিছুটা নজর পড়বে রাজ্যের। তাতে যদি অবস্থা বদলায়।” বিধায়ক শহরবাসীর জন্য যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তাকে স্বাগত জানিয়ে সিউড়ির বধূ দেবশ্রী মিত্র, কঙ্কনা চট্টপাধ্যায়, শিউলি করেরা বলছেন, “আমাদের অসুবিধা দূর করতে, এমন একটা পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল।”

সিপিএমের জেলা সম্পাদক রামচন্দ্র ডোম বলেন, “যে দলটা আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্থ সেখানে পুরসভার দুর্নীতি নতুন কোনও বিষয় নয়। তবে দলের বিধায়ক হয়ে তিনি যেভাবে সামনে এনেছেন তাকে সাধুবাদ জানাই।”

কী বলছেন বিজেপির জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল? সন্দেহ নেই, পুরভোটের আগে বিরোধীদের হাতে বিধায়ক অবশ্যই অস্ত্র তুলে দিয়েছেন। সেই ইঙ্গিত দিয়ে দুধকুমার বলেন, “আগামী পুরভোটে এর ফায়দা তোলার চেষ্টা করবে বিজেপি। এ জন্য স্বপনবাবুকে ধন্যবাদ। বিধায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।”

অন্য বিষয়গুলি:

suri dayal sengupta swapan kanti ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE