ইন্দাসের রোলগ্রামে বাসিন্দাদের সঙ্গে বিডিও। নিজস্ব চিত্র
ঝোপ সরিয়ে জলের বোতল বাগিয়ে সবে বসতে যাবেন, হঠাৎ ঘাড়ের কাছে ফুরুরু... করে বেজে উঠল বাঁশি। আবার কাউকে মাঝ পথে থামিয়ে হাতে মিষ্টি ধরিয়ে চাট্টি কথা শুনিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জেলাকে নির্মল করতে নামা বাঁকুড়ার প্রশাসনিক আধিকারিকদের এমনই তৎপরতা শুরু হয়েছে গত কয়েকদিন ধরে। তাঁদের লক্ষ একটাই, যে ভাবে হোক মাঠঘাটের বদলে মানুষকে শৌচাগারে অভ্যস্ত করে তোলা।
ইতিমধ্যে এই জেলার বেশ কয়েকটি ব্লক নির্মল ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু, বাড়িতে শৌচাগার থাকতেও বাসিন্দাদের অনেকেই ভোরে মাঠে যাওয়া বন্ধ করছেন না। মিশন নির্মল বাংলা প্রকল্পের সফলতায় কিছু মানুষের এই পুরনো অভ্যাস কাঁটার মতো হয়ে রয়েছে। তাই তাদের যেনতেন প্রকারে শৌচাগার ব্যবহারে অভ্যস্ত করে তুলতে উদ্যোগী হয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলাশাসকের নির্দেশে মাঠে নেমে পড়েছেন জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্তা থেকে ব্লক আধিকারিকেরা। তাঁদের সঙ্গে ছুটতে হচ্ছে পুলিশ কর্মীদেরও।
ইন্দাসের রোল গ্রামে সম্প্রতি এক ভোরে চাদর জড়িয়ে হাজির হন বিডিও মানসী ভদ্র। তাঁর সঙ্গে পুলিশ দেখে হকচকিয়ে যান বাসিন্দারা। অনেকে ঘ়টি, বোতলে জল ভরে মাঠের দিকে হাঁটা লাগিয়েছিলেন। তাঁদের থামিয়ে দেন বিডিও। এক কম বয়সি ছেলেকে থামিয়ে তিনি জানতে চান, বাড়িতে শৌচাগার করে দেওয়ার পরেও কেন ভোরে মাঠে ছুটছেন? ছেলেটি আমতা আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। বিডিও তাঁকে থামিয়ে বলেন, ‘‘আগে একটা লাড্ডু মুখে নাও। যা বলছি শোন মন দিয়ে।’’ সঙ্গে থাকা ফটোগ্রাফার আর অফিস কর্মীদের ছেলেটির ছবি আর নাম লিখে রাখতে বলে মানসীদেবী বোঝাতে শুরু করেন, ‘‘পুকুর পাড় নোংরা করার পরে তা বৃষ্টিতে ধুয়ে গিয়ে জলে মিশছে। পরে সেই জলেই তুমি মুখ ধুচ্ছো। অনেকে সেই জলে থালা-বাসন ধুচ্ছেন। স্নানও করছেন। তাতে মলের জীবাণু কত শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। এ ভাবেই পেটের রোগ-সহ কত রোগকে মানুষ ডেকে আনছে। তাই শৌচাগার ব্যবহার করলে অনেক রোগ ঠেকানো সম্ভব। সম্ভ্রমও বাঁচে।’’
রোল গ্রামের কিছু বাসিন্দা আবার জানাচ্ছেন, তাঁরাও বহুবার খোলা জায়গায় শৌচকর্ম করতে বারণ করছেন। এমনকী মাইকে প্রচারও করা হয়েছে। বিডিও বলেন, ‘‘আমি কিন্তু আবার ওই গ্রামে যাব। অন্য গ্রামেও নজর রাখছি। মানুষকে স্বাস্থ্য সচেতন হতেই হবে।’’ ইতিমধ্যে তিনি শাসপুর ও বৈকুণ্ঠপুরেও গিয়েছেন।
রাইপুরের বিডিও সঞ্জীব দাস জানান, গত কয়েক দিনে তিনি রাইপুর, মটগোদা, ফুলকুসমা, ঢেকো ও সোনাগাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের বিভিন্ন এলাকায় সকালে যান। যেখানেই তিনি মানুষজনকে খোলা জায়গায় শৌচকর্ম করতে দেখলেন, সেখানেই তিনি ফুটবলের রেফারির বাঁশি বাজান। তাঁদের ডেকে সচেতন করেন। বিডিও বলেন, ‘‘গ্রামবাসীদের একটাই কথা, বদ্ধ জায়গায় তাঁরা শৌচকর্ম করতে অভ্যস্ত নয়। আমরা তাদের বলেছি, পরিবারের সবাইকে ভাল রাখতে গেলে, রোগব্যাধি থেকে দূরে থাকতে গেলে শৌচাগার ব্যবহার করতেই হবে।’’
শুধু ইন্দাস বা রাইপুরেই নয়, গত এক সপ্তাহ জুড়ে জেলার প্রায় প্রতিটি ব্লক প্রশাসন এই সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে বসেআঁকো, চিঠি লেখা-সহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা করেছে। জেলাশাসক উমাশঙ্কর এস সাইকেলে নিজে বাঁকুড়ার তিলাবেদিয়া গ্রাম ঘুরে আসেন। বাইরে শৌচকর্ম করতে আসা গ্রামবাসীদের তিনি সতর্ক করেন। জেলার অন্যান্য ব্লকের বিডিওরা এলাকায় গিয়ে মানুষকে সচেতন করছেন।
মাসখানেক আগে নির্মল ব্লকের শিরোপা পাওয়ার পরেও ইন্দাসের কিছু মানুষ এখনও কেন মাঠে যাচ্ছেন? ইন্দাস ব্লক প্রশাসন সূত্রে খবর, চলতি বছরের মার্চ মাসে ২০১২ সালের ‘বেস লাইন’ সমীক্ষা অনুযায়ী শৌচালয়হীন ২২ হাজার ৫০২টি বাড়ির সব ক’টিতেই শৌচাগার তৈরি করা হয়েছে।
যদিও রোল গ্রামের ঘোষপাড়ার তিরোধর বাগদি, খোকন বাগদি, উত্তম রায়ের অভিযোগ, ‘‘ঘরে শৌচালয় করার জন্য এক বছর আগে ৯০০ টাকা করে পঞ্চায়েতে জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু শৌচাগার তৈরি হয়নি। পঞ্চায়েতও টাকা ফেরত দিচ্ছে না। তাই ঝোপেঝাড়েই যাচ্ছি।’’
কী বলছেন বিডিও? তিনি বলেন, ‘‘রোলগ্রামের কিছু বাসিন্দা টাকা দিয়েও শৌচাগার না পাওয়ার কথা আমাকেও জানিয়েছেন। বেসলাইন সমীক্ষায় ওঁদের নাম ছিল না। সেই জন্য তাঁরা পাননি। তবে, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের মাধ্যমে শৌচাগার তৈরি করে দেওয়ার জন্য ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি হচ্ছে। ডিসেম্বরের মধ্যে তাঁরা শৌচাগার পাবেন।’’
বিডিও জানান, ৯০০ টাকা নেওয়ার স্লিপ দেখালে, তাঁদের কাছে আর টাকা চাওয়া হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy