মাত্র দু’দিনের শরীর। হাসপাতালের টেবিলে সেই দেহেই চলল ছুড়ি কাঁচি।
খয়রাশোল ব্লক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক সদ্যোজাতের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ খুঁজে পেতে রবিবার দুপুরে এ ভাবেই ময়না-তদন্ত করানো হল সিউড়ি সদর হাসপাতালে।
শনিবার বিকালে খয়রাশোলের নাকড়াকোন্দা ব্লক হাসপাতালে ওই সদ্যোজাত শিশুকন্যার মৃত্যুর পরেই এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়ায়। অভিযোগ, ব্লক হাসপাতালে ৩৫ ঘণ্টা ধরে ভর্তি থাকা সত্ত্বেও একটি বারও কম ওজন নিয়ে জন্মানো ওই শিশুটিকে দেখতে আসেনি কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা। না অন্যত্র রেফার করা হয়েছে। সন্তানের মৃত্যুর পরে ব্লক ও জেলা প্রশাসনের সর্ব স্তরে মৌখিক অভিযোগ জানান খয়রাশোলের পলপাই গ্রামের ওই দম্পতি। তার পরেই নড়েচড়ে বসে স্বাস্থ্য দফতর ও প্রশাসন। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক হিমাদ্রি আড়ি বলেন, ‘‘অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। ময়না-তদন্ত থেকে কারণ বোঝা যাবে। তবে, চিকিৎসায় কোনও গাফিলতি ছিল কিনা, আদৌ শিশুটেকে রেফার করার প্রয়োজন ছিল কিনা, কর্তব্যরত চিকিৎসকদের ভূমিকাই বা কী ছিল, সবটাই আমরা তদন্ত করে দেখছি।’’
খয়ারশোলের হজরতপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পলপাই গ্রামের বাসিন্দা ভৈরব মণ্ডল এবং তাঁর স্ত্রী মধুমিতা। পেশায় কৃষিজীবী ভৈরববাবুদের আগে একটি সন্তান রয়েছে। মধুমিতা দ্বিতীয়বার সন্তান সম্ভবা হন। বহস্পতিবার গভীর রাতে প্রসব যন্ত্রণা অনুভব করছিলেন তিনি। প্রথমটা বুঝতে না পারলেও নিশ্চিত হওয়ার পরে ভোর ৪টে নাগাদ হাসপাতালে পৌঁছনোর জন্য ‘নিশ্চয়যান’কে ফোন করে পরিবার। খবর দেওয়া হয় আশাকর্মীকেও। দু’ঘণ্টা পরে সকাল ৬টা নাগাদ যখন নিশ্চয়যান এসে পৌঁছয়, তার আগেই এক শিশুকন্যার জন্ম দেন মধুমিতা।
নিয়ম অনুযায়ী, মা ও সন্তানের মধ্যে যোগসূত্র, নাড়িটি হাসপাতালে কাটা হলে প্রসবটিকে ‘ইন্টিটিউশনাল ডেলিভারি’ ধরা হয়। মধূমিতা বলেন, ‘‘বাচ্চা আমার সুস্থই ছিল। কেবল ওজনটাই কম ছিল। পাছে ওর কিছু হয়, সেই ভয়ে এবং আশাদিদির পরামর্শে সদ্যোজাত শিশুকন্যাকে নিয়ে তড়িঘড়ি ব্লক হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলাম।’’ সেখানেই মা ও শিশুকে আলাদা করে হাসপাতাল।
মধুমিতার অভিযোগ, শুক্রবার সকাল সাড়ে ৬টা থেকে শনিবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত— একমাত্র নার্স ছাড়া কোনও চিকিৎসক একটি বারও তাঁর শিশুকে দেখতে আসেননি। ‘‘বুকের দুধ টানলেও শনিবার সকাল থেকে ওর জ্বর ছিল। সে কথাও কেউ গ্রাহ্য করেননি। বিকালে ৫টা নাগাদ মেয়েটা যখন নীল হয়ে আসছে, ডাক্তারবাবুর কাছে ছুটে যাই। কিন্তু তার পরেই সব শেষ,’’—কাঁদতে কাঁদতে বললেন মধুমিতা। একই বক্তব্য ভৈরববাবুরও। ঘটনার খবর পেয়েই পরিজনেরা হাসপাতালে ছুটে আসেন। তাঁরা বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ব্লক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লোকপুর থানার পুলিশকে ময়না-তদন্ত করার রিকুইজিশন দেয়।
ঘটনা হল, মা ও শিশু মৃত্যু কমাতে জেলায় ১০০ শতাংশ ইন্সিটিউশনাল ডেলিভারির লক্ষ্য নিয়েছে প্রশাসন। তা নিশ্চিত করতে জেলার যে সব অংশে হোম ডেলিভারি বা বাড়িতে প্রসবের সংখ্যা বেশি, সেই সব এলাকার স্বাস্থ্যকর্মীদের ডেকে গত ১৯ অগস্ট সিউড়িতে একটি বৈঠকও করেছে জেলা প্রশাসন। জেলাসাশক পি মোহন গাঁধী, সিএমওএইচ হিমাদ্রি আড়ি-সহ বহু পদস্থ কর্তা সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে সদ্যোজাত শিশু ও প্রসূতিদের মৃত্যুর বিভিন্ন কারণ উঠে আসে। কোথাও যোগযোগ ব্যবস্থার ত্রুটি, সচেতনতার অভাব থেকে প্রতিটি ফিল্ডে আশাকর্মী না থাকা, নিশ্চয়যানের অভাব প্রভূতিকে হোম ডেলিভারি হওয়ার ক্ষেত্রে দায়ী করা হয়েছে। মধূমিতার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তাকে চিকিৎসকদের একাংশ গাফিলতিই বলছেন। তবে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাড়িতে শিশুর জন্ম দেওয়ায় সংক্রমণ থেকেও বিষয়টি ঘটে থাকতে পারে বলে কেউ কেউ অনুমান করছেন।
হাসপাতাল সূত্রের খবর, শিশুটি ভর্তির সময় মৃণ্ময় ঘোষ নামে এক চিকিৎসক দায়িত্বে ছিলেন। পরে দায়িত্বে আসেন প্রসূনকুমার দাস। মৃণ্ময়বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে, গাফিলতির অভিযোগ মানেননি প্রসূন দাস। তাঁর দাবি, ‘‘প্রসূতি বিভাগের ঠিক পাশের ঘরেই আমরা বসি। রুটিন ভিজিট করে দু’বেলা শিশুটিকে দেখা হয়েছে। শিশুটির তেমন কোনও সমস্যা নজরে পড়েনি। শিশুর মা-ও কোনও অসুবিধার কথা জানাননি। শনিবার বিকালে যখন আমাকে ডাকা হয়, তখন শিশুটির মৃত্যু হয়েছে।’’ শিশুটির পরিবার যদিও ওই চিকিৎসকের এই দাবি মানতে নারাজ। প্রশ্ন তুলেছেন অন্য চিকিৎসকেরাও। তাঁদের বক্তব্য, এমনিতেই কম ওজনের শিশুকে ব্লক হাসপাতালে রাখার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। তবু শিশুটিকে কেন সিউড়ি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হল না?
এ ব্যাপারে হাসপাতালের হাতে কম সংখ্যায় নিশ্চয় যান থাকাকেই দুষছেন বিএমওএইচ দেবব্রত পাল। তাঁর বক্তব্য, ‘‘মাত্র তিনটি নিশ্চয়যান রয়েছে। এত বড় ব্লকের বিভিন্ন কোণ থেকে মায়েদের হাসপাতালে নিয়ে আসাটা যে সমস্যার, সন্দেহ নেই। তার উপর কোনও প্রসূতিকে সিউড়ি রেফার করলে সত্যিই গাড়ি পেতে অসুবিধা হয়। আমরা জেলা স্বাস্থ্য দফতরকে জানিয়েছি। অভিযোগের সত্যতা মেনে বিষয়টি দ্রুত মেটানোর আশ্বাস দিয়েছেন সিএমওএইচ-ও।’’
দেবব্রতবাবু এমন দাবি করলেও ওই হাসপাতালের ভূমিকায় ক্ষোভ চেপে রাখেননি খোদ খয়রাশোলের বিডিও তারকনাথ চন্দ্র। তিনি বলেন, ‘‘আমি ঘটনার কথা জানি। আসলে ব্লক হাসপাতাল নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। পাঁচ পাঁচ জন মেডিক্যাল অফিসার দায়িত্বে থাকলেওঅধিকাংশ সময়ই এক জনের বেশি থাকেন না, এমন অভিযোগ করেন এলাকাবাসী। আমি পরিবারটিকে লিখিত দিতে বলেছি। অভিযোগ পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।’’ ওই শিশুর মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন জেলাশাসকও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy