নিস্তার: চাইল্ডলাইনে পাপ্পু। নিজস্ব চিত্র
দিনে একশোটা থালা ধুতেই হবে। তবেই জুটত খাবার। তাও দু’বেলা মোটে চারটি করে শুকনো রুটি। তার বেশি চেয়ে বসলেই গালে পড়ত হোটেল মালিকের চড়-থাপ্পড়! কোনও দিন তার চেয়ে কম কাজ করলেই নেমে আসত অত্যাচার। একপ্রকার ক্রীতদাসের জীবন থেকে পালিয়ে এসে উঠে পড়েছিল ঠিকানা না জানা একটি ট্রেনে। বিহার থেকে দশ বছরের সেই বালক ভাগ্যিস বাঁকুড়া স্টেশনে আরপিএফ জওয়ানদের নজরে পড়ে। ছোট্ট পাপ্পুর অত্যাচারের কাহিনি শুনে আরপিএফ এবং চাইল্ড লাইনের কর্মীরা তাকে সুস্থ জীবনের খোঁজ দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন।
বিহারের বৈশালী জেলার লালগঞ্জ থানার সালেমপুরের পাপ্পু কুমার মালিকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রবিবার বাঁকুড়ায় এসে ইস্তক ভোজপুরিতে একটা কথাই বার বার আউড়ে যাচ্ছে— ‘‘বাঁচতে চাই বলেই পালিয়ে এসেছি।’’ বড়দিনে তাকে চাইল্ড লাইনের হাতে তুলে দেয় আরপিএফ।
পাপ্পুর কাছে দিনের পর দিন তার উপরে হয়ে যাওয়া অত্যাচারের কথা শুনে ও তার হাত-পায়ে ক্ষত চিহ্ন দেখে আঁতকে ওঠেন চাইল্ড লাইনের কর্তারা। বাঁকুড়া চাইল্ড লাইনের কো-অর্ডিনেটর সজল শীল জানান, ওই শিশু শ্রমিকের বাবা মারা গিয়েছেন। চার ভাইবোনের মধ্যে পাপ্পু মেজো। বাড়িতে প্রবল আর্থিক অনটন। তাই বিহারের মুজফফরপুরের একটি হোটেলে কাজে ঢোকে সে।
পাপ্পুর সঙ্গে কথা বলে সজলবাবু বলেন, “হোটেলে প্রতি দিন থালা ধুতে হতো পাপ্পুকে। খাবারও দেওয়া হতো কম। কাজ করতে না পারলেই পাপ্পুকে গরম ছ্যাঁকা দেওয়া হতো। সেই সঙ্গে চলত মারধর।” হোটেল থেকে বেরিয়ে আসার পরেও পাপ্পুর চোখ মুখ থেকে আতঙ্কের ভাব কাটেনি। নিজের সম্পর্কে খুব বেশি কথা বলতেও পারছে না সে। মাঝে মধ্যেই কোনও অজানা আশঙ্কায় গুম হয়ে থাকছে।
ভয় কাটিয়ে ছেলেটাকে আনন্দ দিতে বড়দিনে পাপ্পুকে নতুন গরম জামা, প্যান্ট উপহার দেন চাইল্ড লাইনের কর্মীরা। তাকে কেকও খাওয়ানো হয়। এতে কিছুটা হলেও তাঁদের কাছে সহজ হয়েছে পাপ্পু। সজলবাবু বলেন, “আমরা পাপ্পুর মন থেকে যতটা পারা যায় ভয় কাটানোর চেষ্টা করছি। তবে দিনের পর দিন একটা ভয়ঙ্কর পরিবেশের মধ্যে তাকে কাটাতে হয়েছে। সেই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে তার সময় লাগবে।’’
বাঁকুড়ায় নতুন শিশু কল্যাণ সমিতি গঠিত হয়নি। মঙ্গলবার তাই পাপ্পুকে বীরভূম শিশু কল্যাণ সমিতির কাছে পেশ করা হয়। চাইল্ড লাইন সূত্রে জানা গিয়েছে, বীরভূম শিশু কল্যাণ সমিতি পাপ্পুকে আপাতত বিষ্ণুপুরের সুমঙ্গলম হোমে রেখে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে নির্দেশ দিয়েছে চাইল্ড লাইনকে।
পাপ্পুর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করেছে বাঁকুড়া চাইল্ড লাইন। সজলবাবু বলেন, “বৈশালী চাইল্ড লাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঘটনাটি আমরা জানিয়েছি। ওর পরিবারের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে।’’ বৈশালী চাইল্ড লাইনের কো-অর্ডিনেটর বীরেন্দ্র কুমার এ দিন ফোনে বলেন, “পাপ্পুর পরিবারের লোকজন বাঁকুড়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন।”
শুধু কি তাকে বাড়ি পাঠিয়েই দায় সারবে প্রশাসন? বীরেন্দ্র কুমার বলেন, “পাপ্পুর মতো শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রশাসনের নানা প্রকল্প রয়েছে। সে যাতে ওই সব প্রকল্পের সুবিধা পায়, আর যাতে হোটেলে ফিরতে না হয়, সে জন্য আমরা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব। পাপ্পুকে স্কুলেও ভর্তি করা হবে।”
তিনি জানান, শিশু কল্যাণ সমিতি নির্দেশ দিলে ওই হোটেল মালিকের বিরুদ্ধেও থানায় অভিযোগ দায়ের করবে চাইল্ড লাইন। বাঁকুড়ার চাইল্ড লাইনের কর্মীরাও চাইছেন, অত্যাচারের জীবন থেকে মুক্তি খুঁজতে ছেলেটা বড়দিনে তাঁদের কাছে এসেছে। তাই তাকে সুস্থ জীবন উপহার দেওয়ার তাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy