Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

দুর্ঘটনায় মৃত্যু বাবার, চোখের জল মুছে পরীক্ষা দিল দীপিকা

রবিবার রাতে ছাতনা-শালতোড়া রাস্তার শালোনিমোড়ে দু’টি ট্রাকের মুখোমুখি ধাক্কা লাগে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই ঘটনায় তিন জন জখম হন। মৃত্যু হয় ঝাঁটিপাহাড়ির আনন্দবাজার এলাকার বাসিন্দা ট্রাকচালক সুবোধ বাউরির (৪৫)।

পরীক্ষার পরে ভেঙে পড়েছে কিশোরী। নিজস্ব চিত্র

পরীক্ষার পরে ভেঙে পড়েছে কিশোরী। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
ছাতনা শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৮ ০৪:৫৫
Share: Save:

জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় বসার আগে সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটা দিতে হল দীপিকাকে।

দীপিকা বাউড়ি। রবিবার রাতে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে বাবার। চোখের জল চোখেই শুকিয়েছে। সোমবার সকালে ছাতনা বাসুলী বালিকা বাণীপিঠের পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছে গিয়েছে মেয়েটি। বেরিয়ে জানিয়েছে, বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে তাকে বসতেই হতো পরীক্ষায়।

রবিবার রাতে ছাতনা-শালতোড়া রাস্তার শালোনিমোড়ে দু’টি ট্রাকের মুখোমুখি ধাক্কা লাগে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই ঘটনায় তিন জন জখম হন। মৃত্যু হয় ঝাঁটিপাহাড়ির আনন্দবাজার এলাকার বাসিন্দা ট্রাকচালক সুবোধ বাউরির (৪৫)। সুবোধবাবু ট্রাক নিয়ে শালতোড়ার দিকে যাচ্ছিলেন। শালোনিমোড়ে এক সাইকেলচালক আচমকা রাস্তার মাঝে উঠে আসেন। পাশ কাটাতে গিয়ে মুখোমুখি হয়ে যায় দু’টি ট্রাক। জখমদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাঁকুড়া মেডিক্যালে। চিকিৎসক জানান, সুবোধবাবুর মৃত্যু হয়েছে।

সুবোধবাবুর মেজ মেয়ে দীপিকা। এ বারের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। ওই ঘটনার পরে সে পরীক্ষায় বসতে পারবে কি না তা নিয়েই সংশয় তৈরি হয় পরিবার ও পড়শিদের মধ্যে। দীপিকাই সিদ্ধান্তই নেয়— পরীক্ষায় বসবে। দুর্ঘটনার পরে সুবোধবাবুর দেহ রাখা ছিল বাঁকুড়া মেডিক্যালে। সোমবার ময়না তদন্তের পরে ছাড়া হয়। দীপিকা যাওয়ার আগে বাড়ির লোকজনকে শুধু বলেছিল, পরীক্ষা দিয়ে ফিরে যেন শেষ বারের মতো বাবাকে একটি বার দেখতে পায়।

ঝাঁটিপাহাড়ি প্রীতিকল্যাণ গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রী দীপিকা। স্কুলের তরফে পরীক্ষাকেন্দ্রে আগেই ঘটনার কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই স্কুলের শিক্ষিকারাও পাশে এসে দাঁড়ান। দীপিকার যাতে কোনও সমস্যা না হয়, সে জন্য সর্বক্ষণ নজর রেখেছেন শিক্ষিকা লীপিকা মাঝি, শোভনা চট্টোপাধ্যায়, শিউলি মুখোপাধ্যায়, সমিতা করেরা। পরীক্ষা শেষ হলে বাণীপিঠের প্রধান শিক্ষিকা রীতা চট্টোপাধ্যায় তাকে ডেকে নেন নিজের ঘরে। পরীক্ষার কিছুক্ষণ কোনও রকমে নিজেকে সামলে রেখেছিল কিশোরীটি। রীতাদেবীর সামনে কান্নায় ভেঙে পড়ে। পরে রীতাদেবী বলেন, ‘‘মেয়েটা অনেক বড় পরীক্ষা দিল। মাধ্যমিক পরীক্ষা, তার ফলাফল এর কাছে কিছুই নয়।’’

আর দীপিকা? এক দিনেই অনেক বড় হয়ে গিয়েছে যেন সে। পরীক্ষা শেষে বলে, ‘‘বাবা অনেক দিন ধরেই বলে আসছিল, ভাল করে মাধ্যমিক দিতে হবে। আমি ভাল ফল করব এটা ছিল বাবার স্বপ্ন। অনেক কষ্ট করে পড়ার খরচ জোগাড় করেছে। সেই বাবাকে তো সারা জীবনের মতো হারালাম। কিন্তু তার স্বপ্নটাও যদি সত্যি না করতে পারি, তাহলে কোনও দিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।’’

পরীক্ষা দিয়ে বিকেলে বাড়ি পৌঁছয় কিশোরীটি। মা কল্যাণীদেবী অঝোরে কেঁদে চলেছেন। সান্ত্বনা দিচ্ছেন শাশুড়ি শোভাদেবী। মাটির দেওয়াল। টালির ছাউনি। চার বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে দীপিকা মেজ। বড় দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আত্মীয় আর পড়শিরা জানান, ট্রাক চালিয়ে সংসার টানতেন সুবোধবাবু। বড় মেয়েকেও পড়িয়েছেন মাধ্যমিক পর্যন্ত। দীপিকা আর তার অন্য ভাই বোনেরাও পড়াশোনা করছে।

কল্যাণীদেবী বলেন, “নিজে বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারেনি। খেদ ছিল। স্বপ্ন ছিল, ছেলে মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত করে তুলবে। দীপিকাকে বলেছিল, যতদূর পড়তে চায় পড়ানো হবে। ওদের লেখাপড়া শেখানোর জন্যই দিনরাত এক করে খাটত আমার স্বামী।”

আর সেই মেয়ের পরীক্ষার আগের দিন সব ওলটপালট হয়ে গেল। পড়শি উমাশঙ্কর দাস বলেন, “গোটা গ্রামই থমথমে হয়ে গিয়েছে। পরিবারটি খুবই দুঃস্থ। কত দিন ধরে মেয়েটা মাধ্যমিকের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। পরীক্ষার সময়ে কী যে হল!’’

দীপিকার চোয়াল শক্ত। বাবার স্বপ্ন সে সত্যি করবেই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy