Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
বাঁকুড়ায় গোঁজ প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন তোলা শুরু

আমরা তৃণমূল নই, ঘোষণা বিক্ষুব্ধদের

বিক্ষোভের পূর্বাভাস ছিলই। হলও তাই। এবং হল একেবারে প্রকাশ্যে। বাঁকুড়ায় পুরভোটের জন্য তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা বেরোতেই সুর চড়াতে শুরু করলেন বিক্ষুব্ধেরা। এমনিতেই জেলার তিন পুরসভায় পুরভোটের প্রার্থী বাছাইকে কেন্দ্র করে শাসক দলে তীব্র মতানৈক্য ছিল।

জেলাশাসকের দফতর থেকে মনোনয়নপত্র তুলে বেরিয়ে আসছেন রেখাদেবীরা। —নিজস্ব চিত্র।

জেলাশাসকের দফতর থেকে মনোনয়নপত্র তুলে বেরিয়ে আসছেন রেখাদেবীরা। —নিজস্ব চিত্র।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৫ ০১:৪২
Share: Save:

বিক্ষোভের পূর্বাভাস ছিলই। হলও তাই। এবং হল একেবারে প্রকাশ্যে।

বাঁকুড়ায় পুরভোটের জন্য তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা বেরোতেই সুর চড়াতে শুরু করলেন বিক্ষুব্ধেরা। এমনিতেই জেলার তিন পুরসভায় পুরভোটের প্রার্থী বাছাইকে কেন্দ্র করে শাসক দলে তীব্র মতানৈক্য ছিল। অশান্তি এড়াতে প্রার্থী তালিকা তৃণমূল ভবন থেকে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল আগেই। তাতেও জট কাটল না। বৃহস্পতিবার বাঁকুড়া পুরসভার চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করতে পারলেও বিষ্ণুপুর ও সোনামুখীকে ঘিরে তৃণমূলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপানউতোরের জন্য শুক্রবারও ওই দুই পুরসভার প্রার্থী তালিকা বেরোল না।

বস্তুত, ওই দুই পুরসভায় তালিকা প্রকাশ্যে আসলেই দ্বন্দ্ব প্রকট হতে পারে বুঝেই আপাতত প্রার্থীদের নাম আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করছে না তৃণমূল। সোনামুখীর বিধায়ক দীপালি সাহা বলেন, “আমরা প্রার্থী তালিকা বের করব মনোনয়নপত্র দেওয়ার পরে। তার আগে নয়।” বিষ্ণুপুরের বিদায়ী পুরপ্রধান তথা রাজ্যের মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “কয়েকটি ওয়ার্ড নিয়ে মতান্তর রয়েছে। তাই চূড়ান্ত তালিকা হয়নি।”

বাঁকুড়া শহরে অবশ্য দলীয় দ্বন্দ্ব একেবারে কাছাখোলা হয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে ওই পুরসভার প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হয়। আর শুক্রবার সকালেই জোট বেঁধে দলের উচ্চ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন বিক্ষুব্ধ অংশ। যার নেতৃত্ব দীর্ঘদিনের তৃণমূল কাউন্সিলর তথা বিদায়ী পুরবোর্ডের অন্যতম চেয়ারম্যান-ইন-কাউন্সিল রেখা দাস রজক। এ দিন তিনি-সহ তৃণমূলের ৬ জন বিক্ষুব্ধ নির্দল প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন তুলেছেন নিজেদের পছন্দসই ওয়ার্ডে দাঁড়ানোর জন্য। রেখাদেবীকে ৫ নম্বর ওয়ার্ডে টিকিট দিয়েছে দল। তাঁর গোসা সেখানেই। কারণ, গত তিনটি পুরভোটে তিনি ৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জিতে এসেছেন। তবে এর আগে ওয়ার্ডটি সংরক্ষণের আওতায় ছিল। এ বার আর সংরক্ষণের আওতায় নেই। তাই প্রথম থেকেই রেখাদেবীকে সংরক্ষিত ওয়ার্ড ৫ নম্বরে সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দল।

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

তৃণমূল সূত্রের খবর, ৭ নম্বর ওয়ার্ড সংরক্ষণের আওতায় এসে পড়ায় ওই ওয়ার্ডের দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর তথা প্রাক্তন পুরপ্রধান শান্তি সিংহকে রেখাদেবীর ‘গড়’ হিসাবে পরিচিত ৬ নম্বরে প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। রেখাদেবী তা মানতে নারাজ ছিলেন প্রথম থেকেই। প্রার্থী তালিকাতেও রেখাদেবীকে ৫ নম্বরে এবং শান্তিবাবুকে ৬ নম্বরে টিকিট দেওয়া হয়েছে। সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই আপাতত হাঁটছেন রেখাদেবী। শুক্রবার তিনি ৬ নম্বর ওয়ার্ডের জন্য মনোনয়নপত্র তুলেছেন। তাঁর ক্ষোভ, “দল সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটা বৈঠক করার সৌজন্য পর্যন্ত দেখায়নি। এমনকী, আমাকে ৫ নম্বর ওয়ার্ডে টিকিট দিয়েছে, সেটাও লোক মুখে জানতে হচ্ছে! নিজের কর্মীদের প্রতি দলের যদি এই কর্তব্য হয়, তাহলে ক্ষোভ তো বাড়বেই।”

এ দিন রেখাদেবীর সঙ্গেই ছিলেন বাম সমর্থিত নির্দল হিসেবে বাঁকুড়া পুরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জিতে গত লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূলে যোগ দেওয়া কাউন্সিলর বিশ্বজিত্‌ কুণ্ডু। পুরভোটে তৃণমূলের টিকিট তিনি পাননি। অথচ বিদায়ী পুরপ্রধান শম্পা দরিপা তাঁর জন্য কম সওয়াল করেননি। ৩ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী করেছে বাঁকুড়ার বিধায়ক মিনতি মিশ্রের অনুগামী দিলীপ অগ্রবালকে। এতে ক্ষুব্ধ বিশ্বজিবাবুত্‌ রেখাদেবীর সঙ্গেই এ দিন নির্দল হয়ে দাঁড়ানোর জন্য মনোনয়নপত্র তুলেছেন। প্রকাশ্যেই তাঁর দাবি, “বিধায়ক ও শম্পা দরিপার গোষ্ঠী কোন্দলের মাঝে পড়েই আমি টিকিট পেলাম না! তবে তাতে কিছু এসে যায় না। ওই ওয়ার্ডের মানুষ আমাকেই প্রার্থী হিসেবে চেয়েছেন। অতীতেও তৃণমূলের প্রার্থীরা আমার কাছে হেরেছেন। এ বারও শেষ হাসি আমিই হাসব!”

২০ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী তৃণমূল কাউন্সিলর দেবদাস দাস এ বার সংরক্ষিত ওয়ার্ড ৭ নম্বরে দাঁড়াচ্ছেন বলে আগেই গুঞ্জন উঠেছিল। দেবদাসবাবুকে ঠেকাতে আগেই সরব হয়েছিলেন ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল কর্মীরা। ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর শান্তি সিংহ আবার প্রার্থী হিসেবে এলাকার তৃণমূল কর্মী প্রদীপ বাগদির নাম প্রস্তাব করেছিলেন দলের কাছে। শেষ পর্যন্ত দেবদাসকেই ওই ওয়ার্ডের প্রার্থী করেছে তৃণমূল। এর প্রতিবাদে নির্দল হিসেবে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রদীপ। এ দিন রেখাদেবীর সঙ্গে তিনিও মনোনয়নপত্র তুলেছেন। প্রদীপ বলেন, “রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই তৃণমূলে। আজ যখন ওয়ার্ডের টিকিট চাইলাম, দল দিল না। উল্টে এলাকাবাসীর আপত্তি সত্ত্বেও বাইরে থেকে এক জনকে জোর করে প্রার্থী করল। এই দলের কোনও নীতিই নেই। এ বার তৃণমূলের বিরুদ্ধে আমরা এক জোট হয়ে লড়ব!”

একই ভাবে ১২ নম্বর ওয়ার্ডের নির্দল প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র তুলেছেন এলাকার পরিচিত তৃণমূল কর্মী জিতেন দাস। ওই ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর তথা গত পুরবোর্ডের উপপুরপ্রধান অলকা সেন মজুমদারের ঘনিষ্ঠ জিতেনবাবু। দলীয়ভাবে ওই ওয়ার্ডে প্রবীর দাসকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। অন্য দিকে, ৪ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন প্রাক্তন পুরপ্রধান দেবপ্রসাদ (তারা) কুণ্ডু। এ দিন ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল কর্মী সন্তোষ গরাই ওরফে সন্টু নির্দল হয়ে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখাদেবীর সঙ্গে মনোনয়নপত্র তুলেছেন। সন্তোষ বলেন, “দল যাঁকে (তারাবাবু) প্রার্থী করেছে, তাঁকে এলাকার কর্মীরা মানতে পারছেন না। তাই সবার কথা ভেবেই আমি নির্দলে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

অথচ ঘটনা হল সম্প্রতি শুশুনিয়ায় এসে খোদ দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন তারাবাবুকে যাতে পছন্দসই জায়গায় টিকিট দেওয়া হয়। এ দিন সন্তোষরা চলে যাওয়ার পরেই মনোনয়নপত্র তুলতে এসেছিলেন তারাবাবু। তিনি বিষয়টি নিয়ে বলেন, “দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাঁরা যায়, তাঁরা আর যাই হোক দলের একনিষ্ঠ কর্মী হতে পারেন না। এই ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়েছি জনসাধারণের অনুমতি নিয়েই।” একই ভাবে বাঁকুড়া পুরসভায় নতূন ওয়ার্ড ২৪ নম্বরেও তৃণমূলের দলীয় প্রার্থী হিরণ চট্টরাজের বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছেন দলেরই একাংশ। এ দিন ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল নেতা রঞ্জিত কুমার মজুমদার রেখাদেবীদের সঙ্গেই মনোনয়নপত্র তুলেছেন নির্দল হিসেবে। তাঁর ক্ষোভ, “প্রার্থী বাছার ক্ষেত্রে দল এলাকাবাসী বা দলীয় কর্মীদের মত নেয়নি। তাই নির্দল হয়ে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।” আর হিরণবাবু বলেন, “দলের একটাই প্রতীক। সেই প্রতীককেই সাধারণ মানুষ আশীর্বাদ দেবেন।”

বাঁকুড়ায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে দলের কর্মীদের গোঁজ প্রার্থী হয়ে লড়ার ঘটনা মানুষ আগেও দেখেছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে টিকিট না পাওয়ায় নির্দল হয়ে তৃণমূলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিল দলের একটি অংশ। যদিও ভোটের ফলে তার প্রভাব পড়েনি। যদিও জেলা তৃণমূলের কোর কমিটির সদস্য তথা জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী বলেন, “যাঁরা প্রকৃত তৃণমূল, তাঁরা কখনওই দলের বিরুদ্ধে যাবেন না। প্রার্থী হতে অনেকেই চাইতে পারেন। কিন্তু দল তো একটি ওয়ার্ডে একজনকেই টিকিট দেবে! অভিমান করে যাঁরা মনোনয়নপত্র তুলেছেন, তাঁরা শেষ অবধি তা জমা দেবেন না বলেই আমি আশা করছি।”

যদিও এ দিন জেলাশাসকের দফতর চত্বরে দাঁড়িয়ে বিক্ষুব্ধ রেখাদেবী, প্রদীপবাবু, বিশ্বজিত্‌বাবুদের ঘোষণা, “আমরা এখন আর তৃণমূল নই। আমরা মানুষের প্রতিনিধি।” ভোটে জিতলে কি শেষে আবার দলে যোগ দেবেন? “প্রশ্নই নেই”- জবাব এল একযোগে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE