এনআরসি নিয়ে ধন্দে ভিড় ব্যাঙ্কে। রামপুরহাটে। নিজস্ব চিত্র
হঠাৎই আতঙ্ক চেপে ধরেছে প্রান্তিক মানুষগুলোকে। এ আতঙ্ক ভিটেমাটি হারানোর। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, কোচবিহারের মতো বীরভূমেও এনআরসি বা নাগরিক পঞ্জির ভয় ঢুকেছে ছাপোষা মানুষের মনে। আধার কার্ডে ভুল সংশোধন কিংবা কার্ডই যাঁদের নেই, তাঁরা নতুন করে কার্ড করাতে বুধবার মাঝরাত থেকে ভিড় করেছেন রামপুরহাটের সানঘাটাপাড়ার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কটির সামনে। বৃহস্পতিবার সকাল গড়িয়ে ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর দুটো ছুঁয়েছে। শ’দুয়েক মানুষের উৎকন্ঠা ভরা মুখ ব্যাঙ্কের সামনের রাস্তায় ঠা-ঠা রোদ মাথায় করে প্রতীক্ষায়। কারও খাওয়া হয়নি সকাল থেকে, কেউ আবার তেষ্টা চেপে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন, জল খেতে গেলে পাছে পিছিয়ে পড়তে হয়!
আর ব্যাঙ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম তো লাটে উঠেছে এ দিন। ভিড় সামলাতে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হয়েছেন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ।
অসমে এনআরসি হওয়া ইস্তক সেখানকার মানুষের আতঙ্ক, আত্মহত্যার খবর সংবাদমাধ্যমের দৌলতে অজনা নয় মহম্মদবাজারের সেকেড্ডা, তারাপীঠের সন্ধ্যাজোল, নলহাটির চামটিবাগান বা রামপুরহাটের মহেন্দ্রপুর, মাড়গ্রামের কুতুবপুরের মতো প্রান্তিক এলাকার বাসিন্দাদেরও। পড়শি জেলাগুলিতেও ব্যাঙ্কে লাইন দিয়ে আধার কার্ড সংশোধন বা নতুন আধার কার্ড করার খবর পাচ্ছিলেন তাঁরা। দিন কয়েক ধরেই একটু একটু করে রামপুরহাটের ব্যাঙ্কটিতেও এই সংক্রান্ত কাউন্টারে ভিড় হচ্ছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকালে ব্যাঙ্কে ঢোকার সময় শাখা প্রবন্ধক আশিস রঞ্জনের চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড় হয়। প্রতিদিন যেখানে ব্যাঙ্কে সাকুল্যে জনা পনেরোর আধার কার্ড সংশোধন বা নতুন আধার কার্ডের ফর্ম দেওয়া হয় সেখানে প্রায় পাঁচশো লোক এসে দাঁড়িয়ে আছেন। কেমন ভাবে সামাল দেবেন এত লোককে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ।
ব্যাঙ্কের এক কর্মী বললেন, ‘‘শুধু কি মহম্মদবাজার, তারাপীঠ! মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি, রঘুনাথগঞ্জের খিদিরপুর, খড়গ্রামের নোনাডাঙা কোথাকার লোক নেই! সকলের এক প্রশ্ন আধার কার্ডে এবারে আর কোনও ভুল থাকবে না তো? কার্ড হলে আর ভিটেছাড়া করবে না তো সরকার? কী উত্তর দেব তাঁদের, তাই মাথায় আসছিল না।’’ আরও কর্মীরা জানান, রামপুরহাটে কোনও ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে ভিড়ের জন্য আর আধার কার্ড সংশোধনের কাউন্টার খোলা থাকছে না। তাই এখানেই সবাই ভিড় করছেন। এ দিন দুশো জনের নাম নথিভুক্ত করা হয়েছে। তাঁদেরকে নির্দিষ্ট তারিখে ব্যাঙ্কে আসতে বলা হয়েছে।
সানঘাটাপাড়ার বাসিন্দারা জানান, বুধবার রাত দুটো থেকে ব্যাঙ্কের সামনে একজন-দু’জন করে মানুষ জড়ো হতে থাকেন। ভোর চারটে থেকে লাইন লম্বা হতে শুরু করে। বেলা বাড়ার পরে কয়েক জন গরমে অসুস্থও হয়ে পড়েন। প্রত্যেকেরই চোখে মুখে অনিশ্চয়তার ছাপ। ব্যাঙ্ক কর্মীদের ঢুকতে দেখেই ছেঁকে ধরেন কয়েকজন। কার্ড করার জন্য কী কী করতে হবে-সহ হাজারো প্রশ্ন তাঁদের। ব্যাঙ্ক কর্মীরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান এমন পরিস্থিতিতে। খোদ ম্যানেজারই বলেন, ‘‘এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি।’’ বেলা ১২টা পর্যন্ত লাইন মোটামুটি সোজা থাকলেও গরমে অধৈর্য হয়ে পড়েন লাইনে দাঁড়ানো লোকেরা। পুলিশ দিয়ে এর পরে লাইন সামাল দিতে হয়।
প্রায় ১১ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানো সাগরদিঘির বাসিন্দা পেশায় ব্যবসায়ী শাহানওয়াজ দেওয়ান বলেন, ‘‘পরিবারের ১৪ জন সদস্যের আধার কার্ডেই ভুল। কারও নামের বানান ভুল, কারও বাবার নাম ভুল, কারও জন্ম তারিখ ভুল। সাগরদিঘির ডাকঘর, ব্যাঙ্ক গত পনেরো দিন ধরে ঘুরে ঘুরে হয়রান হয়ে শেষ পর্যন্ত রামপুরহাটে এসেছি। ওখানে তো কেউ দিশা দেখাতে পারল না। যদি এখানে হয় এই আশায়।’’ মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের খিদিরপুর এলাকায় বাপের বাড়ি শিউলি খাতুনের। বীরভূমের নলহাটি থানার কানুপাড়া গ্রামে এক বছর আগে বিয়ে হয়। আধারকার্ড সংশোধনের জন্য ভোর থেকে লাইন দিয়েও দুপুর দুটোতে ব্যাঙ্কের সামনে পৌঁছতে পারেননি তিনি।
মহম্মদবাজারের সেকেড্ডা গ্রামের বাসিন্দা রফিক শেখের আবার আধার কার্ডই হয়নি। নতুন কার্ডের জন্য তিনিও ডাকঘর, এ ব্যাঙ্ক সে ব্যাঙ্ক ঘুরে সানঘাটাপাড়ার ব্যাঙ্কে লাইন দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘সরকার বলছে এনআরসি হলে যাদের নাম নথিভুক্ত থাকবে না, তারা ভিটেছাড়া হবে। জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে তাদের। আজন্ম এই দেশে বাস করলাম। এখন যদি পরিবারের এক জনকেও ভিটেছাড়া হতে হয় এনআরসি’র কোপে পড়ে তাহলে কী উপায় হবে এই আতঙ্কে এক দিন কেন দরকার হলে আবারও লাইনে
দাঁড়াতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy