Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

পালিয়ে বিয়ে রুখল দামিনী

পড়াশোনা করার ইচ্ছে থাকলেও পঞ্চম শ্রেণির পরে আর তার পড়া হয়নি। তখন বলা হয়েছিল, বাড়ির কাজ করো। মেনে নিয়েছিল সে। কিন্তু, এ বার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল পরিবার। মঙ্গলবার গায়ে হলুদ। আজ, বুধবার ছিল বিয়ে। সেটা আর মেনে নিতে পারেনি বছর ষোলোর কিশোরী দামিনীর (নাম পরিবর্তিত)।

দয়াল সেনগুপ্ত
খয়রাশোল শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৫ ০০:৪৫
Share: Save:

পড়াশোনা করার ইচ্ছে থাকলেও পঞ্চম শ্রেণির পরে আর তার পড়া হয়নি। তখন বলা হয়েছিল, বাড়ির কাজ করো। মেনে নিয়েছিল সে। কিন্তু, এ বার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল পরিবার। মঙ্গলবার গায়ে হলুদ। আজ, বুধবার ছিল বিয়ে। সেটা আর মেনে নিতে পারেনি বছর ষোলোর কিশোরী দামিনীর (নাম পরিবর্তিত)। তাই রাগে-দুঃখে সোমবারই খয়রাশোল থানা এলাকার বাড়ি থেকে পালিয়েছিল সে। কিন্তু, কোথায় যাবে, কী করবে কিছুই ঠিক ছিল না। যখন বুঝল পালাতে গিয়ে ভুল করে ফেলেছে, তখন সন্ধ্যা গড়িয়েছে। রাজনগরের চন্দ্রপুরে বসে কাঁদছিল দামিনী। ঠিক তখনই তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় রাজনগর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সুকুমার সাধুর। রাতে নিজের কাছে রেখে সুকুমারবাবুই মঙ্গলবার সকালে প্রশাসনের কাছে খবর পাঠান। খয়রাশোলের বিডিও তারকনাথ চন্দ্র এবং পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অসীমা ধীবরকে ওই নাবালিকার বিয়ে রুখতে অনুরোধ করেন। শেষ পর্যন্ত খয়রাশোলের ব্লক প্রশাসনের তৎপরতায় দামিনীর বাবা-মা-কে ডেকে তাঁদের বুঝিয়ে রুখে দেওয়া গেল নাবালিকার বিয়ে।

স্থানীয় সূত্রের খবর, ওই নাবালিকার বাবা পেশায় দিনমজুর। মা ঘর সামলানোর পাশাপাশি কখনও সখনও স্বামীর সঙ্গে কাজে যান। অভাবের সংসারে তিন মেয়ের পরে যখন একটি ছেলে হল, তখনই পড়াশোনায় ছেদ পড়ে বড় মেয়ে দামিনীর। তখন সে স্থানীয় নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। তর পর থেকে বাবা-মায়ের কাজে সাহায্য করাই কাজ ছিল ওর। মেয়েরা পর পর বড় হচ্ছে দেখে, বড় মেয়ের বিয়ের ঠিক করে ফেলেন বাবা। দুবরাজপুর থানা এলাকায় ওই নাবালিকার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। পাত্র পেশায় রং মিস্ত্রি। সমস্ত আয়োজনই সারা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, ৪৮ ঘণ্টা আগেই বিয়ে রোখার সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে একরত্তি ওই মেয়ে। দিনভর খুঁজেও দৃঢ়চেতা মেয়ের হদিস বের করতে পারেনি পরিবার।

মঙ্গলবার সকালেই ব্লক প্রশাসনের থেকে যোগাযোগ করা হলে মেয়ের খবর পান বাবা-মা। বিডিও তারকনাথ চন্দ্র জেলার বৈঠকে গিয়েছিলেন। তাই সভাপতি আসীমা ধীবরই দায়িত্ব নিয়ে বাবা-মা-কে ব্লক অফিসে ডেকে পাঠান। খবর দেন খয়রাশোল থানাকেও। কিন্তু, ব্লকে এসেই মাথায় হাত পড়ে পরিবারের। কারণ, নাবালিকা বিয়ে বেআইনি কাজ। তাই এই বিয়ে বন্ধ করতে হবে। ওসি সঞ্জয় শ্রীবাস্তব এবং অসীমাদেবী তখন বাবা-মা-কে জিজ্ঞাসা করে চলেছেন, ‘‘কেন নাবালক মেয়ের বিয়ে দিচ্ছিলেন? ১৮ বছরের আগে মেয়েরা শারীরিক ও মানসিক ভাবে তৈরি হয় না, জানতেন না? আইনে বারণ রয়েছে, জানেন না?’’ অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ে দিলে হাজতে থাকতে হবে জানতে পেরে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে দামিনীর বাবা-মা বলার চেষ্টা করেন, ‘‘বিশ্বাস করুন এ সব কথা জানতাম না। মেয়েও যে বিয়ে করতে চায় না, সে কথাও আগে বলেনি।’’

দামিনীর পরিবারের অভিযোগ, বিয়ের জন্য পাত্রপক্ষ আগেই ৩০ হাজার টাকা পণ নিয়েছে। সে কথা জানতে পেরে এ দিনই পাত্রপক্ষের থেকে পণের টাকা আদায় করতে সাহায্য করার আশ্বাস দেয় প্রশাসন। এর পরেই বাড়িতে গিয়ে মেয়ের উপর কোনও অত্যাচার করা হবে না এবং ১৮ বছরের আগে বিয়ে দেবেন না— এই মর্মে মুচলেকা দিয়ে তবেই রেহাই পেলেন দামিনীর বাবা-মা। বাড়ি ফিরে তাঁদের আক্ষেপ, ‘‘মেয়ে যদি আগে সে ভাবে বলতো বিয়ে করতে রাজি নয়, তা হলে এমন অভিজ্ঞতা হতো না।’’ খড়ের ছাউনি বাড়ির সামনে বিয়ের জন্য তৈরি হওয়া বাঁশের খাঁচাটা ওই দম্পতির দুঃখ যেন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। অসীমাদেবী এবং তারকবাবুরা অবশ্য বলছেন, ‘‘ওই দম্পতির অভিজ্ঞতার কথা জেনে বাকিরাও শিক্ষা নিন। সঠিক বয়সের আগে কোনও ভাবেই মেয়ের বিয়ে দেবেন না। এতে আপনারা যে নিজের মেয়েরই ক্ষতি ডেকে আনছেন, সেটা বুঝতে শিখুন।’’ অন্য দিকে, গোটা ঘটনায় হতাশ পাত্রের পরিবার। খয়রাশোল ব্লক ও দুবরাজপুর থানার পুলিশ পণের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা জানিয়ে দেওয়ায় টনক নড়েছে তাঁদেরও। তবে, পাত্রের মায়ের এখন দাবি, ‘‘ওরাই তো মেয়ের আসল বয়স লুকিয়ে ছিলেন। আমরা জানতাম না।’’

সাহসী দামিনী বলছে, ‘‘এখন আমি কিছুতেই বিয়ে করব না। ফের পড়াশোনা শুরু করতে চাই। প্রশাসন সাহায্য করলে ভরসা পাব।’’ তবে, এখন সে মনে করছে বাড়ি থেকে এ ভাবে পালিয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি। অসীমাদেবী এবং তারকবাবু, দু’জনেই বলছেন, ‘‘একটি নাবালিকার বিয়ে আটকানো গেল, সেটাই বড় কথা। দামিনী যদি পড়াশোনা করতে চায়, তার জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে প্রশাসন।’’ পাশাপাশি অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিলে কী ক্ষতি, তা নিয়ে ওই গ্রামে সচেতনতা শিবির করার কথাও ভাবছে প্রশাসন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE