ক্ষীরোদপ্রসাদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের একটি ঘরের এখন এই হাল। ছবিটি তুলেছেন অভিজিৎ সিংহ।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা বলে কথা। তাই সাইকেলের গুঁতোয় ক্লাস রুম বেমালুম বনে গিয়েছে গ্যারেজ! গায়েব টেবিল চেয়ার! ঠাঁই হচ্ছে না ছাত্রছাত্রীদেরও!
পডুয়াদের মধ্যে সাইকেল বিলির পিছনে বিরোধীরা যতই ভোটের স্বার্থ দেখুন না কেন, শাসক দলের দাবি, সাইকেলে চড়ে উৎসাহিতই হবে পড়ুয়ারা। তবে এই সাইকেলের সৌজন্যেই দিন কুড়ি ধরে পঠনপাঠন বন্ধ রয়েছে বাঁকুড়া শহর লাগোয়া বিকনা এলাকার ক্ষীরোদপ্রসাদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছে জেলার নানা মহলে।
কেন এই অবস্থা?
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, আগে ঠিক ছিল দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদেরই সাইকেল দেওয়া হবে। কিন্তু, সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী একাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদেরও সাইকেল দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ক্ষীরোদপ্রসাদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠে বাঁকুড়া ২ ব্লকের স্কুলগুলিতে বিলি করার জন্য আসা মোট সাইকেলের এক বড় অংশ মজুত রাখা শুরু হয়। স্কুল সূত্রের খবর, এই মুহূর্তে ওই স্কুলে প্রায় দেড় হাজার সাইকেল রয়েছে। ১০টি ক্লাসঘর ছেড়ে দিয়েও পর্যাপ্ত জায়গা হয়নি এতগুলি সাইকেলের। ফলে স্কুলের বারান্দাতেও সাইকেল রাখার জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে স্কুলের দোতলায় উঠতে গেলেও পড়ুয়াদের ঠোকা খেতে হচ্ছে সাইকেলের হ্যান্ডেলে। স্কুলের ২২টি ক্লাসঘরের মধ্যে ১০টি সাইকেলের দখলে চলে যাওয়ায় দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পড়াশোনা আপাতত বন্ধ রেখেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছেলেমেয়েরা যদিও প্র্যাকটিকাল করতে স্কুলে আসছে।
দশম শ্রেণির পড়ুয়াদের প্রায় এক মাস হতে চলল স্কুলের চৌহদ্দিই মাড়াতে হয়নি! ওই ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা এ ভাবে টানা ক্লাস না হওয়ায় সমস্যায় পড়েছে। তাদের অনেকের কথায়, ‘‘আগামী বছর মাধ্যমিক। তার আগে এত দিন স্কুল না হওয়ায় পড়াশোনায় ক্ষতি হয়ে গেল। সিলেবাসই তো শেষ হবে না! এর পরে আবার পুজোর ছুটি পড়ে যাবে।’’ পড়ুয়াদের পাশাপাশিই এ ভাবে দিনের পর দিন ক্লাস না হওয়ায় ক্ষুব্ধ অভিভাবকেরাও। কিন্তু, প্রকাশ্যে কিছু বলতে তাঁরা নারাজ। কিছু অভিভাবক বলছেন, এ রকম ছবি ভোটের সময় দেখা যায়। তখন পুলিশ বা আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের থাকার জন্য গোটা স্কুল বা স্কুলের অনেকগুলি ক্লাসঘর ছেড়ে রাখতে হয়। নির্বাচনের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞের ক্ষেত্রে সে না হয় মেনে নেওয়া যায়। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষাকেন্দ্র হলেও না হয় মেনে নেওয়া যেত। ‘‘তা বলে স্রেফ সাইকেল মজুত রাখার জন্য গোটা ক্লাস বন্ধ থাকবে, এ কেমন কথা?’’— প্রশ্ন ওই স্কুলের অনেক অভিভাবকের। ছাত্রীদের মধ্যে সাইকেল বিলির সরকারি উদ্যোগের প্রশংসা করেও তাঁরা মনে করেন, এই সাইকেল রাখার জন্য আগেভাগেই বিকল্প ব্যবস্থা চিন্তা করা উচিত ছিল জেলা প্রশাসনের।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক আশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমি সমস্যার কথা জেলা স্কুল পরিদর্শক ও প্রশাসনকে জানিয়েছি লিখিত ভাবে। ওঁরা এসে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেও গিয়েছেন।’’ স্কুলের আর এক শিক্ষক খানিকটা মজা করেই বললেন, ‘‘একে তো এমনই পড়ুয়াদের বড় অংশ সাইকেলে চেপেই স্কুলে আসে। তা রাখা থাকে স্কুলের সামনে। এখন আবার বিলি করার জন্য সাইকেলও রাখা থাকছে। সব মিলিয়ে সাইকেলময় হয়ে উঠেছে আমাদের স্কুল।’’ জেলা স্কুল পরিদর্শক (মাধ্যমিক) পঙ্কজ রায় বলেন, “সমস্যার কথা জানি। প্রশাসনিক কর্তাদেরও জানানো হয়েছে। সাইকেল সরানোর বিষয়ে যা পদক্ষেপ করার প্রশাসনের কর্তারাই করবেন।’’ বিষয়টি নিয়ে অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটেছে প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিক বলে দিলেন, “উপর থেকে অর্ডার না আসা সাইকেল সরানো যাবে না।’’
এখনও পর্যন্ত বাঁকুড়া জেলায় ২২টি ব্লকের সব ক’টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল মিলিয়ে প্রায় ১ লক্ষ ৩ হাজার সাইকেল প্রাপকের তালিকা তৈরি করেছে জেলা প্রশাসন। তবে একাদশ শ্রেণি যুক্ত হওয়ায় প্রাপকের সংখ্যাটা আরও বাড়বে বলেই জানাচ্ছেন আধিকারিকেরা। কবে থেকে শুরু হবে স্কুলে স্কুলে সাইকেল বিলি, তা নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে ইতিমধ্যেই জেলায় বহু সাইকেল চলে এসেছে। সাইকেলগুলি কিছু ব্লক অফিসে ও কিছু স্কুলে স্কুলে রাখা হয়েছে।
এবিটিএ-র বাঁকুড়া সদর মহকুমা সম্পাদক আশিস পান্ডের ক্ষোভ, “৩০০ টাকার পাঠ্যবই দিতে শিক্ষাবর্ষের ছ’মাস কাটিয়ে দেয় রাজ্য সরকার। সেখানে ৩ হাজার টাকার সাইকেল দিতে কত তোড়জোড়! পঠন পাঠন না সাইকেল বিলি, কোনটাকে সরকার বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না।’’ তাঁর আরও অভিযোগ, বন্ধের দিনে স্কুল কামাই করার উপায় নেই ছাত্র থেকে শিক্ষকদের। এ দিকে সাইকেল বিলির জন্য এক মাস ক্লাস হচ্ছে না। এ সব ভোটের চমক ছাড়া আর কিছুই নয়। তৃণমূল শিক্ষা সেলের জেলা সভাপতি গৌতম দাসের পাল্টা দাবি, “বাম আমলে পড়ুয়াদের বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে এর খুবই খারাপ প্রভাব পড়েছিল। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষার প্রসারে সচেতন। তাই সাইকেল বিলি করছেন।’’
কিন্তু সাইকেলের গুঁতোয় যে পড়ুয়ারাই স্কুলে ঢুকতে পারছে না? আর মন্তব্য করতে চাননি গৌতমবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy