Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
প্রশ্নে প্রশাসনও

পরপর মৃত্যুতেও বেহুঁশ যাত্রী

সিউড়ির পর এ বার রামপুরহাট। বাসের ছাদে ঝুঁকির যাত্রাপথে মৃত্যু অব্যহত। কয়েক দিনের ব্যবধানে পর পর দুটি দুর্ঘটনায় নতুন করে পথের নিরাপত্তা নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠছে জেলায়। বাস যাত্রী মালিক সমিতি যেমন প্রশাসনকে দুষছে, প্রশাসন আঙুল তুলছে সমিতির দিকে।

মঙ্গলবার এখানেই মৃত্যু হয়েছে দুই বাসযাত্রীর। তার পরেও একই ছবি। রামপুরহাটের রেলওয়ে আন্ডারপাসে তোলা নিজস্ব চিত্র।

মঙ্গলবার এখানেই মৃত্যু হয়েছে দুই বাসযাত্রীর। তার পরেও একই ছবি। রামপুরহাটের রেলওয়ে আন্ডারপাসে তোলা নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
রামপুরহাট শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৬ ০০:৪৩
Share: Save:

সিউড়ির পর এ বার রামপুরহাট। বাসের ছাদে ঝুঁকির যাত্রাপথে মৃত্যু অব্যহত। কয়েক দিনের ব্যবধানে পর পর দুটি দুর্ঘটনায় নতুন করে পথের নিরাপত্তা নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠছে জেলায়। বাস যাত্রী মালিক সমিতি যেমন প্রশাসনকে দুষছে, প্রশাসন আঙুল তুলছে সমিতির দিকে। অন্য দিকে যাত্রীদের একাংশের দাবি, ব্যবসার সামগ্রী নিয়ে ঝুঁকি জেনেও কম পয়সায় যাতায়াতের জন্যই তাঁরা ছাদে চাপেন!

মঙ্গলবার বিকালে রামপুরহাটের ছ’ ফুঁকো রেল সেতুর তলা দিয়ে বাসের মাথায় চেপে যাওয়ার সময় রেলসেতুতে ধাক্কা লেগে মারা গিয়েছিলেন বিহারের বাসিন্দা লালন ঠাকুর (৫৫)। দুর্ঘটনায় আরও ৫ যাত্রী গুরুতর জখম হয়ে রামপুরহাট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানে রাতের দিকে মারা যান হরেলাল সাহানি নামে বিহারের হরসিধি থানা এলাকার এক যুবক। বাস মালিক সমিতির দাবি, প্রশাসন যদি তাদের নিষেধ করে তাহলেই বাসের ছাদে ওঠা মই খুলে দেব তারা। জেলা প্রশাসন অবশ্য এখনও তেমন কোনও সিদ্ধান্তের কথা এ দিনও শোনায়নি। রামপুরহাট মহকুমাশাসক সুপ্রিয় দাস বলেন, ‘‘বাসের মাথায় যাত্রী বোঝাই করা যাতে না হয় তার জন্য পুলিশকে নজরদারি চালানোর জন্য বলা হবে। এ ব্যপারে আরটিও, বাস মালিক সমিতি ও পুলিশকে জরূরী এক বৈঠক ডাকা হয়েছে।’’

ঘটনা হল, গত মাসের ৫ তারিখই ঠিক একই ভাবে, সিউড়ি-দুবরাজপুর রাস্তায় রেলসেতুর রেলিংয়ে ধাক্কা লাগে সাঁইথিয়ার আমোদপুরের বাসিন্দা সিরাজুল শেখের (২৫)। মাথায় সজোরে ধাক্কা লাগায় ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। গত বছরই এক যুবক বাসের ছাদ থেকে তারে জড়িয়ে নীচে পড়ে গিয়ে মারা যান। জেলা পরিবহণ দফতরের তথ্য বলছে, বাসের ছাদে চেপে গন্তব্যে যাওয়ার পথে গত দেড়-দু’বছরে কম করে ২০-২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার লালন ঠাকুর ও হরেলাল সাহানির মৃত্যু ফের দেখিয়ে দিল একের পর এক মৃত্যুও যাত্রীদের সচেতনতা ফেরাতে পারেনি। তা ছাড়া কেন পুলিশি নজরদারি নেই, কেন বাসকর্মীরা ছাদে ওঠার অনুমতি দেন— যুবকের অকালমৃত্যুতে চেনা প্রশ্নগুলি আরও একবার উঠতে শুরু করল!

সিউড়ির ঘটনা বা মঙ্গলবার রামপুরহাটের ঘটনার পর পুলিশের নজরদারি যে বাড়েনি তার ছবি মিলল বুধবার সকালেও। মর্মান্তিক ঘটনার ২৪ ঘন্টা পার হতে না হতেই সেই রেলসেতুর নীচের তলা দিয়েই দেখা গেল দুমকা–রামপুরহাট রুটের বাসগুলিতে ছাদের উপর মানুষের ভিড়। একই ছবি রামপুরহাট থেকে নারায়ণপুর বা রামপুরহাট থেকে আয়াষ, বৈধড়া যাওয়ার গাড়িগুলিতে। এখনও বাসের ছাদে চেপে বহ যাত্রী রেলসেতু পারাপার করছেন। দেখা গেল, দুমকা থেকে রামপুরহাট আসা একটি বাস থেকে নিশ্চিন্তপুর স্টপেজে পনের জনের বেশি যাত্রী বাসের ছাদ থেকে নামছেন। রেল সেতুর নীচে দিয়ে পারাপারের সময় একজন বয়স্ক যাত্রীকে দেখা গেল বাসের ছাদে শুয়ে পড়তে। এবং বাসটি রামপুরহাট রেলস্টেশন লাগোয়া স্টপেজে যাওয়ার জন্য সেতুর তলা দিয়ে পার হওয়া মাত্র ওই বৃদ্ধযাত্রী আবার উঠে বসলেন।

একই ছবি ছিল এ দিন সিউড়িতে, বোলপুরে, নানুরে, কীর্ণাহারে। বাসের ছাদে ভিড় দেখে অনেকের কাছে প্রশ্ন ছিল, ‘বাসের ছাদে কেন চেপেছেন?’

মুর্শিদাবাদের মজলিশপুর থেকে নানুরে ছাগল বিক্রি করতে এসেছিলেন আতিকুর রহমান। ছাদ থেকে নেমে প্রশ্ন শুনে বললেন, ‘‘বাসের ভিতরে ছাগল নিয়ে উঠতে দেয় না। ছাদে ভাড়াও কম। সেই কারণে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ছাদেই চাপি।’’ ছাদে উঠলে ভাড়া কম, সে কথা বললেন গুসকরার জালপাড়া থেকে নানুরে আসা পেয়ারা বিক্রেতা নবকুমার বিত্তার, সাঁইথিয়ায় কোটাসুরের ব্যবসায়ী সুমন বিশ্বাসও। কেউ বলছেন, ‘‘ভিতরে ভিড়। রুটে বাসের সংখ্যা কম।’’ তো কেউ বলছেন, ‘‘মাল নিয়ে যেতে সুবিধা হয়।’’ অনেকে আবার ভিতরে ভিড় না থাকলেও ছাদে বসতেই অভ্যস্ত। রামপুরহাটে মৃত লালন ঠাকুরের জ্যাঠা উমাশঙ্কর ঠাকুর যেমন এ দিন বললেন, ‘‘চম্পাহারি এবং মতিহারি এই দুই জেলার ৪৫ জন যাত্রী নিয়ে দেওঘরে বাবাধাম দর্শন করে তারাপীঠে মা তারা দর্শন করতে এসেছিলাম। বাসের ভিতরে ফাঁকা সিট ছিল। তা সত্ত্বেও রামপুরহাট ঢোকার আগে নতুন জায়গা দেখার জন্য ছ’জন যাত্রী বাসের মাথায় চাপে। কিন্তু রেল সেতুর নীচ দিয়ে পেরোনোর সময় পাঁচ জন যাত্রীর মাথায় লোহার বিমের ধাক্কা লাগে।’’

বীরভূম জেলা বাস মালিক সমিতির দাবি, জেলায় এখন ৬০০ - ৬৫০ বেসরকারি বাস চলছে। সমিতির জেলা সভাপতি শুভাশিস মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন, ‘‘বাসের ছাদে যাত্রী চাপানো আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু বাস মালিকদের পক্ষে বাসের তিন চার জন কর্মীদের দিয়ে তা বন্ধ করা মুশকিল।’’ তাঁর দাবি, ‘‘এর জন্য ঝামেলা বাস মালিকদের সহ্য করতে হয়। বাসের ছাদে কোনও রকম কিছু অঘটন ঘটলে তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। উলটে পুলিশ আমাদের বিরুদ্ধেই কেস দেয়। বাসের ছাদের যাত্রী ওঠা নামা বন্ধ করার ক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রশাসনের সাহায্য দরকার। কিন্তু তারা নীরব।’’

সমিতির মতো কেবল প্রশাসনকেই দুষছেন না নিত্যযাত্রীরা। তাঁরা মানছেন, নজরদারি বাড়ালে হয়তো দুর্ঘটনা আটকানো যাবে। ‘‘তবে অনেকে আছেন, ব্যবসার মাল নিয়ে যান বলে বাসের ছাদে চাপেন। আবার কেউ কেউ আছেন ভিতরে জায়গা থাকলেও ছাদে ওঠেন। সেক্ষেত্রে বাস মালিক সমিতি যদি সিধান্ত নেয়, তাহলে এই মৃত্যু মিছিল আটকানো যায়। প্রশাসন ও বাস মালিক সমিতি— উভয়কে সেক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে।’’ বলছিলেন বোলপুর-পালিতপুর রুটের নিত্যযাত্রী দেবপ্রসাদ সাহা। একই কথা বললেন সিউড়ি-দুবরাজপুর রুটের বাসযাত্রী দয়াশঙ্কর পাঠক বা সাঁইথিয়া-তারাপীঠ রুটের যাত্রী তাপস দাস। তাপসবাবু বলেন, ‘‘এটা ঠিক, ভিতরে ভিড় থাকলে অনেক সময় আমাদের প্রবণতা থাকে ছাদে উঠে পড়ার। কম দূরত্ব থাকলে দরজার হাতল ধরে বাম্পারে ঝুলেও পড়েন অনেকে। এতেই দুর্ঘটনা বাড়ছে। আর রাস্তার যা অবস্থা জেলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে! প্রাণ হাতে নিয়ে উঠতে হয়। সেক্ষেত্রে, প্রশাসন নজরদারি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীদেরও সচেতন হতে হবে।’’

এ দিন জেলা পরিবহণ আধিকারিক বীর বিক্রম রায় বলেন, ‘‘বাসের ছাদে যাত্রী ওঠা নামা বন্ধ করার ক্ষেত্রে বাস মালিকদের মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে। কারণ, পুলিশ ও প্রশাসন হয়তো এক জায়গায় বাসের ছাদ থেকে যাত্রীদের নামিয়ে দিতে পারে। কিন্তু পরে মাঝ রাস্তায় বাসের ছাদে যাত্রীদের ওঠা নামা নজরদারি বাস মালিকদেরই করতে হবে।’’ রামপুরহাট মহকুমা পুলিশ আধিকারিক কমল বৈরাগ্য বলেন, ‘‘বাসের ছাদে যাত্রী চাপানোর ব্যাপারে পুলিশি নজরদারি বাড়ানো হবে। এবং এ বার বাস মালিকদের প্রয়োজনে জরিমানাও করা হবে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

rampurhat bus passenger concern
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE