ভিড় হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু, ২০১১ সালের তুলনায় সেই ভিড় অনেকটাই কম। পুরুলিয়ায় সিপিএমের জেলা সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশে সূর্যকান্ত মিশ্র। —নিজস্ব চিত্র
জেলা সম্মেলন ঘিরে পুরনো উদ্দীপনা দেখা যায়নি। শুক্রবার দলের প্রকাশ্য সমাবেশেও সেই আগের মতো ভিড় দেখা গেল না।
এ দিন দুপুরে পুরুলিয়া জে কে কলেজের মাঠে সিপিএমের ১৯তম জেলা সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশে দলের পটিলব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “সামনে সেমিফাইনালের লড়াই। তৃণমূলের সরকারকে উচ্ছেদ করো, বাংলা বাঁচাও। পরের লড়াই বিজেপি হটাও দেশ বাঁচাও। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জেনে রাখুন এই সমাবেশ ঘোষণা করছে লড়াইয়ের ময়দান তৈরি হয়েছে।” তখন মাঠে মেরেকেটে ১০ হাজার লোক। অথচ ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতা হারানোর পরেও সিপিএমের সাম্প্রতিক শেষ জেলা সম্মেলনের সমাবেশে ভিড় হয়েছিল এর ঢের বেশি। তবে দলের বর্ষীয়ান নেতা মঞ্চ থেকেই দাবি করেন, “কে বলে আমাদের সম্মেলন নিয়ে তেমন উদ্দীপনা নেই। এখানে এসে তাঁরা দেখা যান প্রতিটা গ্রাম থেকে লোক এসেছে।”
ভিড় শুরু হয়েছিল দুপুর থেকেই। আগের মতোই লাল পতাকা হাতে নিয়ে, ধামসা-মাদল বাজাতে বাজাতে সিপিএমের কর্মী-সমর্থকেরা মিছিল করে মাঠে ঢুকছিলেন। কিন্তু আগে একটি জোনাল কমিটির একাধিক গাড়ি চোখে পড়ত, আশপাশে গাড়ি গিজগিজ করত, সেই ছবিটা এ বার ছিল না। তুলনায় গাড়ির সংখ্যাও কম। সূর্যকান্তবাবু যখন মঞ্চে উঠলেন তখনও মঞ্চের বাঁদিকের কিছুটা অংশ ফাঁকা। তিনি যখন সারদা কাণ্ড নিয়ে রাজ্য সরকারকে বিঁধছেন, তখন দেখা যায় দর্শকাসনের মাঝ থেকে মহিলারা উঠে যাচ্ছেন। আগে যেমন তাঁকে আটকাতে মঞ্চ থেকে অনুরোধ করা হতো, এ বার তেমনটাও চোখে পড়েনি। সমাবেশে আসা অনেক কর্মীই আফসোসের সঙ্গে ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলেন, “ক্ষমতা হারিয়ে গেল বলে কি মানুষগুলোও সব চলে গেল। এই দুর্দিনে দলের সঙ্গে তো থাকা উচিত।”
দু’টি সম্মেলনের মাঝে জেলায় রাজনৈতিক ভাবে তেমন সাফল্য নেই দলের। তাছাড়া চলতি জেলা সম্মেলনের আগে জেলার যে ২১টি জোনাল সম্মেলন হয়েছে, সেখানেও সম্মেলন শেষ হয়েছে একদিন। অতীতে জোনাল সম্মেলনগুলি চলত দেড় দিন ধরে। তা ছাড়া কোনও জোনাল সম্মেলনকে কেন্দ্র করেই প্রকাশ্য সমাবেশের আয়োজনও করেনি দল। কমেছে হাজারের বেশি সদস্য সংখ্যাও। এমতাবস্থায় এই সমাবেশ সফল করাই ছিল কর্মীদের কাছে চ্যালেঞ্জ। সভার পরে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুরুলিয়া শহরের জগন্নাথ কিশোর কলেজের মাঠে উপস্থিত হওয়া কিছু কর্মী এই ভিড় দেখে এখনও সুদিন ফেরার আশা করছেন। তাঁদের প্রতিক্রিয়া, “এই সমাবেশের পর কর্মীরা উজ্জীবিত হবেন। আর সমাবেশ শেষ হওয়ার আগে সেই কথাটিই বলেছেন সমাবেশের প্রধান বক্তা সূযর্কান্ত মিশ্রও। তবে এ দিন সমাবেশে আসা মানুষজনের কাছে বাড়তি পাওনা অবশ্য দলের দীর্ঘদিনের জেলা সম্পাদক থাকা নকুল মাহাতোকে চোখে দেখতে পাওয়া। এই অশীতিপর নেতা গত সম্মেলনে জেলা সম্পাদকের পদ ছাড়েন। তিনি মঞ্চে অনেকক্ষণ ছিলেন। সঙ্গে এনেছিলেন তাঁর মেয়ে তথা মানবাজারের প্রাক্তন বিধায়ক সাম্যপ্যারী মাহাতো। তিনি নকুলবাবুকে হাত ধরে মঞ্চ থেকে নামান। সাম্যপ্যারীদেবী বলেন, “বাবা তিন দিনই সম্মেলনে থাকবেন।”
সূর্যবাবুর বক্তব্যে প্রত্যাশা মতোই তৃণমূলের সঙ্গে সারদা-কাণ্ডের কথা উঠে আসে। তিনি বলেন বলেন, “জোরে বাতাস দিলে বা কুয়াশা পড়লে আমগাছের মুকুলের কী হয়? বলা হচ্ছে, এক মুকুল গেলে হাজার মুকুল আছে। বাতাস দিলে একটা মুকুল পড়ে না, হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ মুকুল ঝরতে শুরু করে।” তিনি দাবি করেন, রাজ্যে ৩৪ বছর বামফ্রন্টের সরকার ইতিহাস তৈরি করেছে। কিন্তু কোনওদিন কেউ একফোঁটা কালি লাগানোর সাহস পেয়েছিলেন? মুকুলবাবুর জেরার পরে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কী হবে তা নিয়েও কটাক্ষ করেন। যে মাঠে এ দিন সভা হচ্ছিল, তার গোলপোস্টের দিকে তাকিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, “উনি এখন পিছোতে পিছোতে গোলকিপারের জার্সি পরবেন নিজের গোল বাঁচানোর জন্য!” তবে রাজ্য সরকারই ছিল তাঁর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য। রাজ্য সরকারের চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি, টেট কেলেঙ্কারি, ত্রিফলা আলো কেলেঙ্কারির প্রসঙ্গ তুলে মুখ্যমন্ত্রীর ১০ লক্ষ বেকারকে কাজ দেওয়ার প্রসঙ্গকেও কটাক্ষ করেন তিনি।
তিনি বলেন, “দশ লক্ষ বেকারের কাজ হবে! কাতারে কাতারে বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। রঘুনাথপুরে তিনটি ইস্পাত কারখানা কোথায় গেল? আসলে উনি শিল্প বলতে বোঝেন গান-বাজনা। এ দিকে শ্রমিকের মজুরির কোনও নিশ্চয়তা নেই।” বাসুদেব আচারিয়া প্রশ্ন করেন, “কী পরিবর্তন হয়েছে? রঘুনাথপুরকে বলা হচ্ছিল দ্বিতীয় দুর্গাপুর। শিল্পায়নের যে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল, তিনটে বড় ইস্পাত কারখানা, ৩০ থেকে ৩৫ হাজার বেকারের কর্মসংস্থান হতো। আজ জেলা, রাজ্য থেকে বেকাররা কাজের আশায় চলে যাচ্ছেন। শিল্প তাড়ানোয় উনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। একটা মোটর গাড়ির কারখানা হলে রাজ্যে আরও মোটর গাড়ির কারখানা হতো। তা তিনি বোঝেননি। শালবনির জমি ফিরিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছেন শিল্পপতিরা।”
সমাবেশ দেখে উজ্জীবিত বলরামপুরের ত্রিলোচন দাস, কাশীপুরের সজল গোস্বামী, বান্দোয়ানের সুশান্ত বেশরা বলেন, “এই সমাবেশ আমাদের বাড়তি আত্মবিশ্বাস জোগাবে।” এটাই এখন জেলা সিপিএম নেতৃত্বের ভরসা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy